ছোটো গল্প হিসেবে রবীন্দ্রনাথের “ একরাত্রি ” কতটা সার্থকতা লাভ করতে পেরেছে ? আলোচনা করা প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- রবীন্দ্রনাথের একটি বিশিষ্ট ছোট গল্প “ একরাত্রি ” গল্পটি সার্থক কিনা সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের জানতে হবে , ছোট গল্প কাকে বলে এবং সার্থক ছোটগল্প হতে গেলে কোন কোন বৈশিষ্ট্য গল্পে থাকা অবশ্যক । স্বরূপের দিক থেকে ছোটগল্প হল গীতি কবিতার দোসর । দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে থেকে কোন ঘটনা , পরিস্থিতি বা পরিবেশের প্রভাবে নরনারীর হৃদয়ে জেগে ওঠা আনন্দ বেদনা ভাব ও অনুভূতিগুলিকে গদ্য ভাষার মাধ্যমে স্বল্প পরিসরের মধ্যে আস্বাদনযোগ্য করে ফুটিয়ে তোলাই হল ছোটগল্পের লক্ষ্য । রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের জন্মদাতা । স্বভাবে কবি বলেই তাঁর গল্পগুলি গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হওয়া খুবই স্বাভাবিক । হৃদয়ে উদ্ভুত গভীর ভাবরাশি এবং অনুভূতির প্রকাশ তাঁর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য । “ একরাত্রি ” গল্পে গল্পকথকের হৃদয়ের সেরকমই কিছু গভীর ভাবের অভিব্যাক্তি ঘটানো হয়েছে । পাঠক তাতে যথার্থই রসাস্বাদনে সমর্থ হন । এ জন্য গল্পটিকে সার্থক ছোটগল্প বলতে বাধা থাকে না ।
[ ] সুরবালা নামের একটি মেয়ের সাথে গল্প কথকের বাল্য প্রণয় ছিল । তাদের বিবাহের ব্যাপারে অভিভাবকদের আগ্রহ ছিল । কিন্তু গল্পকথক লেখাপড়া শিখতে কলকাতায় গিয়ে নেতাদের গরম গরম বক্তৃতার প্রভাবে গারিবালডি হবার স্বপ্ন দেখতে থাকায় আজীবন বিবাহ না করবার সিদ্ধান্ত নেন এবং পিতাকে জানিয়ে দেন “ বিদ্যাভাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না ” তখন সুরবালার অভিভাবকেরা অন্য পাত্রে সুরবালার বিবাহ সম্পন্ন করেন । গল্প কথকের তখন অন্য স্বপ্ন মগ্ন ছিল বলেই সুরবালার প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারেন নি । কিন্তু পিতার মৃত্যুর পরই যখন অর্থনৈতিক চাপে পড়ে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসতে বাধ্য হলেন তখন উপলব্ধি করলেন , সুরবালা তাঁর কতটা । সুরবালার অভাবে জীবনটা তাঁর কতটা ভরসাহীন ।
[ ] অনেক চেষ্টায় গল্পকথক তুচ্ছ একটা স্কুলে সেকেন্ড মাস্টারের পদ পান । স্কুল বাড়িতেই তাঁকে থাকতে হতো । ঘটনাচক্রে এই স্কুলবাড়ির খুব কাছেই সুরবালার স্বামী রামলোচনের বাসা । সৌজন্যবশত , একদিন আলাপ করতেও গিয়েছিলেন , কিন্তু সুরবালার সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের কথা প্রকাশ করতে পারেননি । তার সঙ্গে আলাপ করতেও পারেননি । এত নিকটে সুরবালার সঙ্গে দুটো কথা বলতে না পারার বেদনা গল্প কথক কে অস্থির করে তুলেছে । যে মেয়েটি তাঁর একান্ত আপনজন হতে পারত , সাময়িক ভুলের জন্য সে আজ পরস্ত্রী । জীবনে এ ভুল শোধরাবার আর উপায় নেই । তাই কথক বলেন “ ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না ; তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে ।”
[ ] সুরবালার সান্নিধ্যে যেতে না পারার , আলাপ করতে না পারার চিন্তাই গল্পকথকের বাল্য প্রণয়নকে তীব্র করে তুলেছে । পিপাসা চরিতার্থ হবার উপায় না থাকলে বিরহ বেদনা কে অসাধারণ দক্ষতায় অল্প কথায় ব্যক্ত করেছেন ।
[ ] গল্পের শেষভাগে সুরবালার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করবার জন্য , একবার তাকে দেখবার জন্য গল্প কথকের মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে । তাকে বিবাহ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে তিনি যে অন্যায় করেছেন তার জন্য অনুতাপদগ্ধ হৃদয়টাকে মেলে ধরতে চেয়েছেন । প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রমলোচনের অনুপস্থিতি সেই সুযোগ তৈরি করে দিল । একদিন রাত্রি দেড়টার সময় বান এসে সব জল মগ্ন হতে থাকে । একাকী , অসহায় সুরবালাকে রক্ষা করতে দ্বিধা সংকোচ সরিয়ে রেখে গল্প কথক ছুটে যান । সুরবালাও বাঁচার তাগিদেই ওদিক থেকে পুষ্করিনীর উঁচু পাড়ে উঠে আসে । সেখানেই নিভৃতে দুজনের সাক্ষাৎ হয় । কিন্তু কেউ কারো কুশলও জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না । তাঁরা নিরবেই যেন নিজেদের মনের কথাগুলি পরস্পরকে জানিয়ে গেলেন । এই টুকুতেই গল্প কথক তৃপ্ত ।
[ ] গল্পটিতে কাহিনীর প্রাধান্য নেই ঘটনার বাহুল্যও নেই । আছে গল্পকথকের অন্তরে জেগে ওঠা কিছু ভাব ও অনুভূতির প্রকাশ । সামাজিক সংস্কারগত বাঁধার জন্য বাল্য প্রণয়নির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারার বেদনা পাঠকের মনে দাগ কেটে যায় । দুর্যোগের রাত্রে কয়েক মিনিটের জন্য কাছে পাওয়ার যে সার্থকতা কথা কথা বলা হয়েছে , তাও বেদনারই নামান্তর । সাহিত্য যা বেদনার , তা আস্বাদনের বিষয় । “ একরাত্রি ” গল্পের বিষয়ও খুবই উপভোগ্য হয়েছে । গল্পটা পড়ার পর পাঠকের মনের মধ্যে অনেকক্ষণ একটা রেশ থাকে । মন হয় যেন , “ “ শেষ হয়ে হইল না শেষ ।” তাই সবদিক থেকেই একরাত্রি একটি সার্থক ছোটগল্প ।
কোন মন্তব্য নেই