অনধিকার প্রবেশ গল্পের জয়কালী চরিত্রটি আলোচনা করো । তার চরিত্রের আকর্ষণীয় দিক কোনটা ? প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- “ অনধিকার প্রবেশ ” গল্পের একটিই মাত্র প্রধান চরিত্র জয়কালী । সে মাধবচন্দ্র তর্কবাঁচস্পতির বিধবা স্ত্রী । স্বামীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সে রাধানাথ জিউর মন্দিরের আধিকারিনী । তবে জয়কালী বাঙালি ঘরের আর পাঁচটা বিধবা রমণীর মতো নয় । যেমন তার পুরুষালি চেহারা , তিনি তাঁর পুরুষালী ব্যক্তিত্ব । আর তার জোরেই সে লোক সমাজে প্রাধান্য পেয়ে যায় ।
[ ] জয়কালী দীর্ঘাকার , তীক্ষ্ণনাসা একটু কাঠ কাঠ চেহারা । আচরনেও কাঠ কাঠ । কোনও মিষ্টতা নেই ! স্বল্পভাষী এবং গভীর প্রকৃতির কথা না বলেও সে মত প্রতিষ্ঠা করতে পারত গাম্ভীর্যের দ্বারা । এমন নিরস মানুষের কেউ সান্নিধ্য কামনা করে না তাই । তাই জয়কালী ছিল সঙ্গীহীনা , একাকিনী ।
[ ] জয়কালীর সঙ্গে কেউ কখনো বাক বিতন্ডায় যেত না , গেলে হারত । তার স্বামী মাধবচন্দ্র তর্কবাঁচস্পতি উপাধি পেলেও স্ত্রীর কাছে কখনো সেই উপাধী প্রমাণ দিতে পারেননি । অথাৎ বারবার তর্কে হেরেছেন । তবে জয়কালীর বিষয় বুদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতাবোধ ছিল যথেষ্ট । মন্দিরের অধিকারিণী হয়ে প্রথমেই সে মন্দিরের বিষয়ে আসয় বুঝে নেয় । অনিয়মগুলো দূর করে । ব্রাহ্মণ পূজারীদের কে আগে সংযত করে । আগে পূজার নৈবেদ্য ভাগ বসানোর ইচ্ছে এবং উপায় থাকলেও জয়কালীর শাসন ও নজরদারিতে সেটা বন্ধ হল । পুজোর খরচা তাতে কমল ।
[ ] পরনিন্দা , পরচর্চা , ছোটকথা , শলাপরামর্শ , অকাজে গল্পগুজবে সময় নষ্ট করা এসব জয়কালী পছন্দ করত না । যারা এসব করত , তাদের সে ঘৃণা করত । তাই পারত পক্ষে জয়কালীর সান্নিধ্য আসতো না । কোনো অনুষ্ঠানে জয়কালী উপস্থিত থাকলে , সেই হয়ে উঠত প্রধান । তার প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব আর সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই তাকে প্রদান করে তুলত ।
[ ] জয়কালী নিঃসন্তান । তবে মাতাপিতৃহীন দুই ভাতুষ্পুত্র জয়কালীর কাছে থাকত । বড়টা ১৮ বছরের , শান্তশিষ্ট হলেও ছোটটা দুরন্ত , দুঃসাহসি , অবাধ্য । কড়া শাসনেও জয়কালী এই ছোটো ভাতুষ্পূত্র টিকে সঠিক পথে চালিত করতে পারেনি । গল্পের শুরু ও শেষে এই অবাধ্য, দুঃসাহসী ভাইপো নলিনের পরিচয় আমরা পাই ।
[ ] পরিছন্নতা বোধ আর পবিত্রতার সংস্কার থেকে জয়কালী অবাঞ্ছিত লোক , পালক দল ও পশুশাবকদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে । এমন কি , অনাচারী আত্মীয়দেরও সে মন্দিরে ঢুকতে দিত না । তাই আপন ভগ্নীপতি কুক্কুট মাংস ভক্ষণ করে , তাকেও মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয়নি । মন্দির প্রাঙ্গণকে সবসময় ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে চাইত বলেই ভাইপোদেরও যখন তখন মন্দিরে আসাটা তাঁর পছন্দ ছিল না ।।তাই মন্দিরের পবিত্র মাধবীবিতান থেকে ফুল তুলে আনা সহজ ছিল না । এই কঠিন কাজটা করতে পারবে বলে বাজি ধরেছিল ছোটভাইপো নলিন । বাজি জিতবার জন্য ফুল তুলতে গিয়ে মাধবীলতাসহ পড়ে গিয়ে সে জয়কালীর হাতে ধরা পড়ে । মন্দিরের প্রাঙ্গণে অনধিকার প্রবেশ ও অপকর্ম করার শাস্তি স্বরূপ জয়কালী তাকে চপেটাঘাত তো করেই , বৈকালিক আহারও বন্ধ করে । কারও অনুরোধেও শাস্তি লাঘব করেনি ।
[ ] জয়কালীর কিছু কিছু সিদ্ধান্ত এবং আচরণে মনে হতেই পারে সে বড় নির্মম । ১৯ বছর বয়স হওয়া সত্বেও বড়ো ভাইপোর বিবাহ দেয়নি , ঘরে বসে বউয়ের আদর খাবে বলে । প্রতিবেশীদের এতে খারাপ লাগলেও জয়কালীর কঠিন হৃদয়েও একটুখানি স্নেহ মমতা ছিল । তার জন্যই সে একটা স্বভাব বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছে । মন্দিরের মাধবীমঞ্জুরী ভাঙার জন্য যেদিন আপন ভাইপো কে শাস্তি দিয়েছে , সেদিনই সেই ভেঙে পড়া মাধবীলতার পল্লবের মধ্যে প্রাণভয়ে লুকিয়ে থাকা অপবিত্র , অচ্ছুত এক শূকর ছানা কে বাঁচতে দেবার জন্য ছানাটির অন্বেষনকারি ডোমদের উদ্দেশ্য বলেছে “ যা বেটারা , ফিরে যায় ? আমার মন্দিরে অপবিত্র করিস নে ।”
[ ] জয়কালীর কথা বিশ্বাস করে মন্দিরে অশুচি শূকরছানাকে জয়কালী আশ্রয় দেয়নি মনে করে ডোমরা চলে গেছে । কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে , জয়কালী এটা কেন করল ? কেন শূকর ছানা টাকে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দিল না ? মন্দিরে পবিত্রতাকি এতে নষ্ট হলো না ? লেখক এব্যাপারে ইঙ্গিত দেবার জন্য বলেছেন “ এই সামান্য ঘটনায় নিথিল জগতের সর্বজীবের মহাদেবতা পরম প্রসন্ন হইলেন কিন্তু ক্ষুদ্র পল্লীর সমাজনামধারী অতিক্ষুদ্র দেবতা টি নিরতিশয় সংক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিল ।” অর্থাৎ জয়কালী সামাজিক সংস্কারকে অগ্রাহ্য করে একটা জীবনকে প্রাণে বাঁচাল । এখানেই জয়কালী হৃদয়বান নারী চরিত্র , আকর্ষণীয় এক নারী চরিত্র ।
কোন মন্তব্য নেই