পোস্টমাস্টার গল্পটি ছোট গল্প হিসেবে কতটা সার্থকতা লাভ করেছে আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের ছোট গল্প গুলির মধ্যে একটি অসাধারণ সার্থক ছোটগল্প “ পোস্টমাস্টার ” জমিদারি দেখা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে ছিলেন , তখন কুঠিবাড়ির এক পোস্টমাস্টারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল । তাঁর প্রায় নিঃসঙ্গ জীবন যাত্রা প্রত্যক্ষ করে কবির মনে যে ভাবনা জেগে উঠেছিল , তাকে প্রকাশ করতেই “পোস্টমাস্টার ” গল্পটি রচনা করেন নিজেই ইন্দিরাদেবীকে লেখা একটি পত্রে বলেছেন “ যখন আমাদের এই কুটিবাড়ির একতলাতেই পোস্ট অফিস ছিল এবং আমি একে প্রতিদিন দেখতে পেতুম তখনই আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতলায় বসে সেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলাম ।”
[ ] আয়তনের দিক থেকে “ পোস্টমাস্টার ” গল্পটি খুবই ছোট । মাত্র চার পাঁচ পাতার । মাত্র চরিত্রকে অবলম্বন করে মানুষের অসাধারণ কিছু অনুভূতির কিছু অবাঞ্চিত অথচ অনিবার্য দুঃখ-বেদনার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে । কলকাতার ছেলে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নিয়ে গ্রাম্য এলাকায় এসেছেন । এখনকার প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর অবস্থা হয়েছে যেন ডাঙায় তোলা মাছ । অবসর কাটাবার তাঁর কোনো উপায় নেই । তাই কাজের মেয়ে রতনকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টায় তিনি ব্রতী হন যেটুকু সময় কাটানো যায় ।
[ ] বারো তেরো বছরের মেয়ে রতন । অভিভাবক নেই বলে তার এখনো বিয়ে হয়নি । নিঃসঙ্গ পোস্টমাস্টার আর নিঃসঙ্গ রতন পরস্পরের সঙ্গী হয়ে উঠল । বাবা মা ভাই বোনদের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে করতে উভয়ের মধ্যে একটা সহজ স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে । উভয়েই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে । “ অবশেষে এমন হইল । বালিকা কথোপকথনকালে তাঁহার ঘরের লোকদিগকে মা দিদি দাদা বলিয়া চিরপরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত । এমনকি তাহার ক্ষুদ্র হৃদয় পটে তাহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল ।”
[ ] এই সম্পর্কটা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল একটা ঘটনায় । পোস্টমাস্টার হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন । একটুখানি সেবা পাবার জন্য পোস্টমাস্টারের যখন মায়ের কথা মনে পড়েছিল তখন এই গ্রাম্য অশিক্ষিত মেয়েটি সেবার সমস্ত দায়িত্ব অত্যন্ত আপন জনের মতো নিজের কাঁধে তুলে নিল । “ বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না । সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল । বৈদ্য ডাকিয়া আনিল , যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল , শিয়রে সারা রাত্রি জাগিয়া রহিল , আপনি পত্য রাধিয়া দিল এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল “ হ্যাঁগো দাদাবাবু ,একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কী !”
[ ] রতনের সেবা যত্নেই যে পোস্টমাস্টার সুস্থ হয়ে ওঠেন তাতে সন্দেহ নেই । দাদাবাবুর প্রতি রতনের যেন খানিকটা অধিকার জন্মে গেলো এভাবেই । কিন্তু পোস্টমাস্টার আর বিপজ্জনক গ্রাম্য পরিবেশে থাকতে চাইলেন না । তিনি বদলির দরখাস্ত পাঠালেন । দরখাস্ত না মঞ্জুর হলে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে প্রস্তুত হলেন । একেবারে অন্তিম লগ্নে রতনকে সে কথা জানালেন “ রতন , কালই আমি যাচ্ছি ।” রতন যখন বুঝেছে তার দাদাবাবু চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন , আর কখনো আসবেন না , তখন এতদিন ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ভিত্তিতে জানতে চায় “ দাদাবাবু আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে ?” পোস্টমাস্টার হেসে দেন , “ সে কি করে হবে ।”
[ ] কেন যে হবে না , কলকাতার অবিবাহিত যুবকের পক্ষে পাড়াগাঁর একটা অজ্ঞাত কুলহীন , অবিবাহিত , সভ্যসমাজের উপযুক্ত শিক্ষা ও সংস্কৃতিহীন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা যে কি , তা রতনের মতো সহজ সরল গ্রাম্য বালিকার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় । তার বিবেচনায় এই প্রশ্নটাই বড়ো হয়ে ওঠে আপনার জন ভেবে যাঁকে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছে তিনি তার জন্য এতটুকু ভাববেন না । দাদাবাবু এত নিষ্ঠুর , এত অকৃতজ্ঞ ।
[ ] রতনে বিষন্নতা প্রত্যক্ষ করে পোস্টমাস্টার ভেবেছিলেন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও খাওয়া পরার কথা ভেবেই রতনের দুশ্চিন্তা । তাই আশ্বাস দিয়েছেন , পরবর্তী যে পোস্টমাস্টার আসছেন , তিনি যাতে রতনকে যত্ন করেন সে ব্যবস্থা করে যাবেন । পথ খরচা বাবদ কিছু রেখে বাকি টাকাগুলো তিনি রতনকে দিতে চেয়েছেন । কিন্তু অভিমানী রতন নিতে চায় নি । বলেছে , “ তোমার দুটি পায়ে পড়ি , আমার জন্য কাউকে কিছু ভাবতে হবে না ।”
[ ] এই অভিমানের স্বরূপ শিক্ষিত পোস্টমাস্টার একেবারেই যে বোঝেন নি তা নয় । গ্রাম্যবালিকার হৃদয়ের ছবিটি তিনি নিশ্চয় অনুমান করতে পেরেছেন , তাই তাঁর মনেও হয়েছে , “ ফিরিয়া যাই , জগতের ক্রোর বিচ্যুতি সেও অনাথিনিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি ।” কিন্তু নানাবিধ প্রতিকুলতায় পোস্টমাস্টারের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়নি । তিনি তত্ত্ব কথাকে আশ্রয় করে সান্ত্বনা খুঁজতে চেয়েছেন , কিন্তু শূন্য হৃদয় রতনের সান্তনা লাভের কোনো উপায় হয় নি । সে এক অসম্ভব আশায় ভর করে দাদাবাবু যদি ফিরে আসেন , এই ভাবনাকে আশ্রয় করে পোস্টঅফিসের চারপাশে ঘুরে বেরিয়েছে ।
[ ] দুটি মাত্র চরিত্রের বিকাশ ও পরিণতির মধ্যে দিয়ে , ক্ষুদ্র পরিসরে । রবীন্দ্রনাথ মানব হৃদয়ের কিছু চিরন্তন অনুভূতিকে অসাধারণ দক্ষতায় জাগিয়ে তুলেছেন । একটি স্বজনহারা গ্রাম্যবালিকার স্নেহলোলুপ হৃদয়ের চিত্র এভাবে আর কোনো গল্পে ফুটে ওঠে নি । ছোটগল্পের সমস্ত বৈশিষ্ট্য এ গল্পে ফুটে উঠেছে । গীতিধর্মিতা , নাটকীয়তা , গতি , চরিত্রসৃষ্টি , স্রষ্টার জীবন দর্শন সবই জীবনদর্শন সবই গল্পটিতে রয়েছে । তাই পোস্টমাস্টার অবশ্যই একটি সার্থক ছোটগল্প ।
প্রশ্নটা ভালোভাবে মিলছে না
উত্তরমুছুন