বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সারদামঙ্গল কাব্যে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য প্রভাব প্রশ্নোত্তর

 

বাংলা অনার্স সাম্মানিক bengali honours সারদামঙ্গল কাব্যে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য প্রভাব প্রশ্নোত্তর

উত্তর:- কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর  “ সারদামঙ্গল ” কাব্যে সারদা পরিকল্পনায় একদিকে যেমন প্রাচীন সংস্কৃতি সাহিত্য , প্রাচ্য পুরানাদির ভাবধারা গ্রহণ করেছেন , তেমনি প্রাশ্চাত্য আদর্শের অনুকরণও কিছুটা করেছেন । এই দুই আদর্শের মিশ্রণে তাঁর “ সারদামঙ্গল ” কাব্য হয়ে উঠেছে অনবদ্য । আমরা প্রথমে আলোচ্য কাব্যে প্রাচ্য ভাবধারা কতটা অনুসৃত হয়েছে তা দেখব ।

‘ কাব্যদর্শের ’ প্রথম শ্লোকে সরস্বতী বন্দনায় দন্ডী বলেছেন 


           চতুমুখামাম্ভোজ বন হংসবধূসম

           মানসে রস্যতাং দীর্ঘং সর্বশুক্লা সরস্বতী ।



সর্বশুক্লা সরস্বতী যেন একটি সর্বশুক্লা হংসবধু ।  কবির প্রাথনা সেই হংসবধু সরস্বতী যেন ব্রহ্মার মুখপদ্মবন থেকে উঠে এসে তাঁর মানস সরোবরে দীর্ঘকালের জন্য কেলি করেনি । বিহারীলালও তাঁর সরস্বতীররুপ সারদা কে “ মানস মরালী সম আনন্দ রুপিনী ” বলে সম্বোধন করেছেন । এক্ষেত্রে বিহারীলালের সারদা বর্ণনায় দন্ডির প্রভাব কিছুটা পড়েছে বলে মনে হয় । তবে দন্ডির সরস্বতী শুধুই আমাদের চির পরিচিতা শুভ্রবর্না সরস্বতী , সারদার ব্যাপকতা তাতে নেই । বিহারীলালের সারদা কখনও জায়া , কখনও নন্দিনী , কখনও দেবী যোগেশ্বরী , কখনও বা আনন্দ রূপিনী সৌন্দর্য লক্ষ্মী । এখানেই বিহারীলালের নিজস্বতা ।

[        ] প্রেম পরিকল্পনায় বিহারীলালের সঙ্গে ভবভূতির সর্বাধিক সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় । অধিকাংশ সংস্কৃত প্রেমকবিতায় প্রেমের প্রধান আলম্বন বিভাব যে নায়িকা , তার বহি:ন্দৌয বর্ণনায় কবিগণ সমগ্র অলঙ্কার উজাড় করে দিয়েছেন । ভবভূতি সেখানে বাহিরের সৌন্দর্যের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে দেখিয়েছেন নায়িকার অন্তর সৌন্দর্য । বিহারীলালেরও বিভাব এই অন্তর লাবণ্যর সার মাধুর্যের আকর 


       নয়ন অমৃত রাশি প্রেয়সী আমার 

       জীবন জুড়ান ধন হৃদি ফুলহার ।



বিহারীলাল অলঙ্কার সৌন্দযের এবং কমনীয় স্নিগ্ধতার দ্যোর্তক । তাঁর নায়িকা “ ষোরশী রূপসী বালা পূর্ণিমা যামিনী ” তাঁর কান্তি শান্তিময় তনু ইন্দ্রধনু ” তাঁর নয়ন কিরণ যেন পীযুষ লহরী । সর্বোপরি কবির নায়িকা করুণারানী । বলা বাহুল্য সৌন্দর্যের সঙ্গে করুনার এই মণিকাঞ্চন যোগ সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্লভ । একমাত্র ভবভূতির সীতা এই করুণার একটি প্রকৃতি দয়া , প্রেম , স্নেহবাৎসল্য ও করুণ রসের যুক্তবেনী ‘ করুণয্য মূর্তিরথবা শরীরিনি বিরহব্যাথা ।

একটু গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায় সারদা পরিকল্পনার পিছনে প্রাচ্য পুরানের চন্ডীকা বা কলিকার সঙ্গে সূক্ষ যোগ আছে । বিশ্বের অন্তনিহিত এক আদ্যশক্তির কল্পনা বহু প্রাচীণ কাল থেকেই হিন্দুর মন অধিকার করে আছে । বেদান্ত ব্রহ্মান্ডকে মায়া দ্বারা রচিত বলা হয়েছে । তন্ত্রের শক্তি এবং বেদান্তের মায়াও পুরানাদিতে এক বলে কিত্তিত হয়েছে । মার্কন্ডেয় চন্ডীতে এই বিশ্বদেবীকে সর্বভূতে মায়া , চেতনা , বুদ্ধি , ক্ষান্তি , শক্তি প্রভৃতি রূপে সংস্থিতা বলে নমস্কার করা হয়েছে । এগুলির মধ্যে বিহারীলাল কান্তি মূর্তি কে গ্রহণ করলেও দেবীর তন্ত্রক্ত মূর্তিও তাঁর মনের অবচেতনে লুক্কায়িত ছিল । এই কারণে সারদা কে দেবী বহু স্থানেই যোগেশ্বরী বলে আখ্যা দিয়েছেন । এই আদ্যশক্তি “ ভোলা মহেশ্বর প্রাণ ” তিনি কখনও “ বরাভয় দাতা ” কখনও “ গেরুয়া পরা ভীষন ত্রিশূল ধরা ” আবার কখনও বা আলু থালু কেশে শশ্মানের প্রান্ত দেশে ” অবস্থিত । তবে এই শক্তির আদর্শকে গ্রহণ করেও বিহারীলাল স্ব অনুভুতি ও কাব্য সাধনার ভিতর দিয়ে তাকে যেভাবে রূপায়িত করেছেন তাতে সারদা কবির আরাধ্যা দেবীই হয়ে উঠেছে ।

[        ] প্রাশ্চাত্য সাহিত্যও সমজাতীয় শক্তির আভাস পাওয়া যায় । ইংরেজ কবি শেলী তাঁর বিশ্বরুপীনি সৌন্দর্য লক্ষ্মী কে সম্বোধন করে বলেছেন “Spirit of Beauty ” শেলীর এই সৌন্দর্যদেবী সমস্ত রহস্যের মূলধারা , তিনি এক অদৃশ্য শক্তি রূপে আমাদের অন্তরে অন্তরে সংগোপনে বিরাজ করেন । রহস্যময়ী বলেই বোধ হয় এই দেবী শেলীর কাছে অধিকতর প্রিয় “ Dear , and yet dearer for its Mystery ” আবার বদলেয়ার যে সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে তাঁর অন্তরের আবেগ নিবেদন করেছিলেন তার উৎস কোথায় জানেন না কবি এবং তার জন্য কোনও ক্ষোভ নেই । শেলী বা বোদলেয়ারে “ বিউটির মতই বিহারীলালের সারদাও রহস্যময়ী এবং বিহারীলাল বদলেয়ার মতই তাঁর সারদার রহস্যভেদ করতে চাননি “ রহস্য ভেদিতে তব আর আমি চাব না ” “ না বুঝিয়া থাকা ভাল / বুঝিলেই নেবে আলো / সে মহাপ্রলয় পথে কভু আমি ধাব না ।”

[       ] কবি কিটসও তার বহু কবিতায় এক সৌন্দর্য দেবীর বর্ণনা করেছেন । তিনি কল্পনার লঘু ডানায় ভর করে বাস্তবে কিছুক্ষণ বিস্মৃত হতে পেরেছিলেন । সারদামঙ্গল তেমনিই দেখি কাব্যের স্বপ্নালোক থেকে বাস্তবের রুক্ষতায় আকস্মিক আবির্ভাবে মোহভঙ্গের বেদনা তীব্র হয়েছে কবির হৃদয়ে “ জাগালে কে জোর করে ? / সাধের স্বপন আহা ! ফুরা’ল ফুরা’ল !” কীটস নাইটিঙ্গল এর সন্ধানে বৃক্ষলতা সমাচ্ছন্ন পরিবেশে আত্মগোপন করেছেন , বিহারীলালও খুঁজেছেন । তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর এই সমস্ত ইংরেজ কবিগনের সঙ্গে বিহারীলালের কিছু কিছু পরিচয় থাকলেও কবির উপর পাশ্চাত্য প্রভাব নগণ্য বলেই মনে হয় । কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিহারীলালের কাব্য সাধনা স্বমহিমায় উজ্জ্বল ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন