সোমবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২১

সারদামঙ্গল কাব্যে বিহারীলাল ত্রিকালের সরস্বতী মূর্তির পরিকল্পনা যেভাবে করেছেন তার বর্ণনা দাও প্রশ্নোত্তর

বাংলা অনার্স সাম্মানিক bengali honours সারদামঙ্গল কাব্যে বিহারীলাল ত্রিকালের সরস্বতী মূর্তির পরিকল্পনা যেভাবে করেছেন তার বর্ণনা দাও প্রশ্নোত্তর saroda mongol kabbo biharilal trikaler saraswati murtir porikolpona jevabe korechen tar bornona dao


উত্তর:- “ সারদামঙ্গল ” কাব্যে বিহারীলাল যে সারদা মূতির কল্পনা করেছেন সে মূর্তির সঙ্গে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে পূজিতা সরস্বতী দেবীর মূর্তির মিল নেই । কবির সারদা এক ও অখন্ড হৃদয়ের অনুভুতির মাধ্যমে সে মূর্তি প্রত্যক্ষ ও শত্রুরুপে বিরাজমান , তিনি জ্যোতিময়ী , সুরুপসী  ও যোগীর ধ্যানের ধন । তিনি যে শুধু  আনন্দময়ী , শুধু প্রেম ও মাধুর্যের সাভূত প্রকাশ তাই নন , তিনি আদ্যশক্তি , জগৎ ও জীবনের ঐক্য বিধায়িত্রি । কবির সারদা যোগীর ধ্যানের ধন । এই দেবী কবির সৌন্দর্য লক্ষ্মী ও তাঁর মানস সুন্দরী । শেলীর “ স্পিরিট ” অফ বিউটির সঙ্গে এই দেবীর খুব মিল । কবি বিহারীলাল তাঁর মানস লক্ষী এই সারদার কথা বলতে গিয়ে দেবীর সঙ্গে তাঁর বিরহ মিলনের কাহিনী “ সারদামঙ্গল ” কাব্য বনির্ত করেছেন । বিহারীলাল তাঁর বন্ধু অনাথবন্ধু রায়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে ‘ সরস্বতীর সঙ্গে প্রেম , বিরহ ও মিলন বুঝতে হলে অনেকগুলি অসর্ববাদি সম্মত কথা কহিতে হয় ।” বাগদেবীকে সৌন্দর্য লক্ষ্মী রূপে কল্পনা করলে প্রকৃতই তা অসর্ববাদি সম্মত হয়ে দাঁড়ায় । সারদা সঙ্গে কবি বিহারীলাল তাঁর হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে সম্বোর্ধন করে বলেছেন  

         ‘ এসো মা করুণারাণী

            ও বিধু বদনখানি 

         হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরিগো আবার ।



কবি তার কল্পিত সারদাকে পূর্ণিমা যামিনীর মতো ষোড়শী রূপসী নারী করে একেছেন । তাঁকে ভেবেছেন তাঁর মানস মরালি বলে । আবার এই দেবীকেই আনন্দরুপী ও ত্রিদিব দেবী কল্পনা করেছেন । জ্যোতি প্রবাহের মধ্যে তিনি বিশ্ব বিমোহিনি প্রেমের প্রতিমা মূর্তিতে বিরাজ করেন আবার তিনি দেবী যোগেশ্বরী ও মত্যরূপা সরস্বতী । এই দেবীর আবির্ভাব ঘটলে রাত্রি শেষের ব্যথিত প্রাণ , শীতল হয় । সূর্য লোকের আড়ালে দেবী অন্তহিতা হলে কবির কাছে জীবন মরুভূমির মতো হয়ে দাঁড়ায় , ফুল ফোট বন্ধ হয়ে যায় । এই দেবী কবির প্রাণকে আকর্ষণ করেন । সারদার সঙ্গে মিলনের অভিপ্রায়ে বিহারীলাল উদ্ধতের মধ্যে অদ্ধৈতানুভূতির আনন্দ উপলব্ধি করতে চান । তাই লেখেন 

            থাকি বা প্রিয়ার বুকে 
              যাই বা মরণ মুখে ,
          এ আমি , আমি তবু ; দেখুক জগৎ ।


এই সারদা কবির কাছে বিশেষ হয়েও নির্বিশেষে তার যোগীর কাছে নির্বিশেষে হয়েও বিশেষ  । কবি সারদা কে দুই রূপে উপলব্ধি করেছেন । একরূপ দৃষ্টিতে , অন্যরূপ যোগীর দৃষ্টিতে কবির দৃষ্টিতে তিনি আনন্দ সরুপিনি বিমূত সৌন্দর্যের সারভুত প্রকাশ ও প্রেমের প্রতীক । আবার যোগীর দৃষ্টিতে তিনি সত্যরক্ষা সরস্বতী । তার মধ্যে মাধুর্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভিষণতা ।  তিনি জগতের ঐক্য বিধান করেন এবং বৈচিত্রের মধ্য অখন্ড স্বরূপের প্রকাশ ঘটান । এই নিত্য স্বরুপার  মধ্যে সমস্ত প্রবাহের ধারা এসে স্তব্ধ ও শান্ত হয় । এই অঞ্চল সত্যের ধ্যান  ইংরেজ কবি শেলীও করেছেন । কবি কিটস একেই নিষ্কলুষ সৌন্দর্যের আদর্শরুপে গ্রহণ করেছেন । বেদনায় ও মানবিক সহানুভূতিতে এই সত্যকে উপলব্ধি করতে হয় । বিহারীলাল তাঁর কবি অনুভবের মাধ্যমে এই উপলব্ধি করেছেন যে তার সৌন্দর্য লক্ষ্মী দেবী সারদা পার্থিব । সৌন্দর্যে পরিশুদ্ধ হয়ে অপার্থিব সৌন্দর্য মূর্তি তে পরিণত হয়েছেন । এই ভাবনারই কাব্যরূপ হলো 

            কটি শশী উপহাসী ,
             উথলে লাবণ্য রাশি ,
            তারল দর্পণে যেন দিগন্ত আবরে ।


ত্রিকালের সরস্বতী মূর্তির পরিচয় দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন যে গাইতে গাইতে হঠাৎ তার মনে বাল্মিকী মুনির আগের কালের কথা উদ্বৃত্ত হল । তার পরে মনে হলে বাল্মিকী কালের কথা । তারপরে কালিদাসের কাল । এই তিন ধরনের সরস্বতী মূর্তি কবির মনে উদিত হবার পর তাঁর চির আনন্দময়ী বিষাদিনি সারদা কখনও স্পষ্ট কখনও বা অস্পষ্ট আবার কখনও বা সদৃশ্য ভাবে বিরাজ করতে লাগলেন । ঐ সরস্বতীর যে মূর্তির ধ্যান কবি করেছেন তা হল 


       কপোলে সুধাংশু ডাস
       অধরে অরুণ ভাস 
      নয়নে করুণা সিন্ধু প্রভাতের তারা জ্বলে ।

এই দেবী নিত্য ও বিশ্বরূপা । মানব সংসারে প্রেমের মূর্তিতে করুণাময়ী রূপে তিনি দেখা দেন।  এই দেবী দর্শনে দর্শনের মনের শোক তাপ দূর হয় । তাই কবিরা তাকে বন্দনা করেন আর যোগীরা করেন আরাধনা । বৈদিকযুগে সরস্বতী ছিলেন মূলত নদী । পড়ে হয়েছেন তার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ও তারও পরে বাগদেবী । তিনি সিংহবাহনা । কেননা তিনি দেবগণের হাত এড়াবার জন্য তিনি সিংহমূর্তি ধরেছিলেন । জ্ঞান 
রুপা জ্যোতির্ময়ী বাগদেবী সরস্বতী গায়ত্রীর সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন । গায়ত্রী মন্ত্রে যে বরণ্য বর্গের কথা বলা হয়েছে তা ব্রহ্মের শক্তি ।  বিহারীলালও লিখেছেন 


         ব্রহ্মার মানসসরে 
         ফুটে ঢল ঢল করে 
         নীল হলে মনোদুরর সুবর্ন নলিনী ।


সারদামঙ্গলের আরম্ভে কবি অমর বালা ঊষার বর্ণনা দিয়েছেন । ওই ঊষারানীর সঙ্গে সারদার আবির্ভাবের জন্য কবি প্রথনা করেছেন । ঊষা চৈতন্যস্বরুপা । কবির ভাবনার সরস্বতীও তাই । ঊষার আবির্ভাবে মানসিক জড়তা দূর হয় । বিহারীলাল ভেবেছেন বাল্মীকির আগের কালের সারদা মূর্তি চৈতন্যস্বরুপা ঊষারই সমতুল ।

দ্বিতীয় সর্গে বাল্মিকী যুগে এই সারদা দেবীর অভিনব আবির্ভাবে বর্ণনা করেছেন কবি । তমসা নদীর ধারে সুন্দর প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাবভোলা বাল্মিকী । সেই শান্ত সুন্দর এক সবর এসে কৌঁচ্ছ মিথুনের মধ্যে কৌঁচ্ছ কে বধ করে । কৌঁচি শোকে অধীর হয়ে করুন কান্নায় অরণ্য পরিবেশে পূর্ন করে তোলে । এই পরিস্থিতিতে বাল্মিকী মুনির বিহুল প্রাণে করুণার বান ডাকে । তখন 

             সহসা ললাটে ভাগে 
             জ্যোতিময়ী কন্যা জাগে 
             জাগিল বিজলী যেন নীলনব ঘনে ।

এই ললাটিকার আবির্ভাবে বাল্মিকীর ললাট দেশ দীপ্ত হল । সে দীপ্ত সমুজ্জ্বল শান্তির ।দেবীর সঙ্গে ঊষার অভিন্নতা বর্ণনা করেছেন বিহারীলাল এইভাবে  

           করে ইন্দ্র ধনু বালা 
           গলায় তারার মালা 
           সীমন্তে নক্ষত্র জ্বলে ঝলমলে কানন ।


সারদা দেবী আবির্ভূতা  হয়ে একবার ক্রঞ্চিকে  একবার বাল্মিকী উন্মাদিনীর মতো ফিরে ফিরে দেখেন । করুণা করে বিষাদসুরে বিনা বাজিয়ে তিনি গান করতে থাকেন । সবকিছু একই সুর ও লয় বিশিষ্ট হয়ে ওঠে । বাল্মীকির প্রফুল্ল কপোল বেয়ে অশ্রু জলের ধারা নামে । কবিরা এই দেবীকে দেখেন ধ্যানের দৃষ্টিতে আর যোগীরা দেখেন যোগের সাধনে । করুণা রুপিনি এই সারদাকে দেখলে শোক তাপ দূরে যায় । মন আনন্দে পূর্ন হয় । জগতের ঐশ্বর্য কে তখন তুচ্ছ বলে বোধ হয় ।


[       ] কালিদাস যে সরস্বতীর বন্দনা করেছেন তিনি হলেন কাব্য সরস্বতী । তাঁর ধ্যানের দৃষ্টিতে জগৎ লক্ষ্মী সৌন্দর্য মূর্তিতে জ্যোতিময়ী শক্তি রূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন । তিনি ব্রহ্মজ্যোতি রূপিনি আদিশক্তি । বিহারীলাল কালীদাস অনুভূত সারদা মূর্তি কে চিরন্তন সৌন্দর্য লক্ষ্মী রুপে “ সারদামঙ্গল ” কাব্য উদ্ভাসিত করে তুলেছেন । এই সরস্বতীর স্তব গানে ত্রিলোক মুখর হয়ে ওঠে । তাঁর রূপ প্রত্যক্ষ করে ‘ অমর কিন্নর নরে ভাসে অশ্রুজলে ।’ জাগ্রত অবস্থায় কবি যখন সারদার কথা ভাবেন তখন শশ্মান ও স্বর্গ এক হয়ে যায় । দেবী কবির পথ প্রদশিকা হয়ে দাঁড়ান । বিহারীলালের সারদা তাই কেবল নিসর্গ সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত নন । তাঁর আবেদন গভীরতর  । এই সারদা কে হারালে কবি নিজেকে প্রাণহারা বলে মনে করেন । এইভাবে ত্রিকালের সরস্বতীর মূর্তির উল্লেখ করে কবি বিহারীলাল তাঁর নিজস্ব পরিকল্পিত সারদা মূর্তির অভিনবত্ব স্পষ্টও অস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন । কবির চেতনায় রোমান্টিকতার সঙ্গে মিষ্টিকতার সংমিশ্রণ ঘটায় রহস্যময়তার একটা আবরণ মাঝে মধ্যে রচিত হয়েছে । তাই কবির সারদা বিশেষ রূপে স্পষ্ট ও নির্বিশেষ রূপে অস্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছেন ।

1 টি মন্তব্য:

  1. সারদামঙ্গল কাব্যের কবি সৌন্দর্য লক্ষীর ধ্যান কাব্য প্রসঙ্গে আলোচনা করো

    উত্তরমুছুন