শনিবার, ২ অক্টোবর, ২০২১

শাক্তপদ রচনায় সাধক রাম প্রসাদ সেনের প্রতিভার পরিচয় দাও প্রশ্নোত্তর

 

বাংলা অনার্স সাম্মানিক bengali honours শাক্তপদ রচনায় সাধক রাম প্রসাদ সেনের প্রতিভার পরিচয় দাও প্রশ্নোত্তর

উত্তর: “ গ্রন্থ যাবে গড়াগড়ি গানে হব ব্যাস্ত ” উক্তিটি বিদ্যাসুন্দরের রচয়িতা রামপ্রসাদ সেনের । তাঁর শাক্ত পদে গ্রন্থলব্ধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দূর হয়ে যায় । রামপ্রসাদ রূপক প্রতীকের আড়ালে বিশ্ব জননীকে লুকিয়ে রেখেছেন । আমরা মাতার বরাভয় লাভ করে নির্ভয় হই , অনাবৃত শিশুর বেশে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি । সাধক কবি আমাদের জন্য এই আশ্বাস ও সান্তনা তাঁর গানে সঞ্চিত করে রেখেছেন । বাইরের প্রতিকূল শক্তি যত দুর্দমই হোক না কেন , জননী কালিকার স্নেহধন্য আশ্রয় পেলে আমরা যমরাজকে অবহেলা করতে পারি । রামপ্রসাদ অন্ধকারের মধ্যে আশার বর্তিকা জেলেছেন । তিনি শুধু কবি বা গায়কমাত্র নন মানুষের তাপ দগ্ধ জীবনে তিনি স্নেহের প্রলেপ দিয়েছেন । মাতৃত্বের তিনি অন্যতম শ্রেষ্ট পূজারী । তবে তাঁর পূর্বে বাংলার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের স্থানে স্থানে শাক্ত পদাবলীর আভাস ফুটে উঠলেও রামপ্রসাদের কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীত শতধারায় প্রবাহিত হয়েছে । তাই তাঁকে শাক্ত পদাবলীর প্রথম পূজারী বলে ধরা যায় । 


[       ] রামপ্রসাদ পদাবলীকে এইভাবে বিভক্ত করা যেতে পারে ( ক ) উমা বিষয়ক ( আগমনী ও বিজয়া )  , ( খ ) সাধন বিষয়ক ( তন্ত্রক্ত সাধনা ) , ( গ ) দেবীর স্বরূপ বিষয়ক , ( ঘ ) তত্ত্ব দর্শন ও নীতি বিষয়ক , ( ঙ ) কবির ব্যাক্তিগত অনুভুতি বিষয়ক ইত্যাদি । অবশ্য রামপ্রসাদের আগমনী ও বিজয়া গানের সংখ্যা নগণ্য , কাব্যেৎকর্ষও এমন কিছু প্রসংশার যোগ্য নয় । বৎসরান্তে উমার হিমাচল ভবনে আগমনে চারিদিকে যখন আনন্দের স্রোতে বয়ে যাচ্ছে তখন দারিদ্রের কথা স্মরণ করে গীরিরানি বলেন 



“ জনক তোমার গিরি           পতি জনম ভিখারী 

          তোমা হেন সুকুমারী দিলাম দিগম্বরে ।।”

মেনকা এই মনোবেদনা কবি বেশ আন্তরিকভাবেই ফুটিয়েছেন । তবে পরবর্তী কবি সাধক ও গায়কগণ বিশেষত কবিওয়ালা গণ এই পর্যায়ের পদে অধিকতর নিপুরণতা দেখিয়েছেন । 



[      ] রামপ্রসাদ স্বয়ং তন্ত্র সাধক ছিলেন । এই সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন । এরূপ জনশ্রুতি আছে । তাঁর গ্রামে এখনো তাঁর সাধন ধামের ধ্বংসাবেশ লক্ষ্য করা যায় । তন্ত্রক্তত সাধনা মূলত সাধকের দেহকেন্দ্রিক সাধনা । কবি বহুপদে এই সমস্ত তত্ত্বকথা বলেছেন ।

      “ তীর্থ গমন মিথ্যা ভ্রমণ 

                     মন উচাটন করো না রে ।

 ও মন ত্রিবেনির পাটেতে বেসে 

                     শীতল হবে অন্তঃপুরে ।।”



  “ ইরা পিঙ্গলা নামা             সুষুম্মা মনোরমা 

       তাঁর মধ্যে গাঁথা শ্যামা ব্রন্থসনাতনী ওমা ।।”



তিনি যে তান্ত্রিক গ্রন্থ অবলম্বনে ও গুরু নির্দেশে তন্ত্র সাধনা করতেন তার ইঙ্গিত এই সাধন ভজন গ্রন্থে পাওয়া যায় । এই পথের পথিকদের নিকট তাঁর তাৎপর্য বিশেষ মূল্যবান হলেও সাহিত্যের ইতিহাসে ও কাব্যরস বিচারে এর বিশেষ মূল্য আছে বলে মনে হয় না । কেবল যেখানে সাধ্য সাধনতত্ত্ব কথা কবির ব্যাক্তিগত অনুভুতি কে স্পর্শ করেছে সেখানে কিঞ্চিৎ শিল্পরসের উদ্ভদ হয়েছে । 

“কালী পদ্মবনে হংস সনে হংসীরূপে করে রমন 

তাঁরে মূলাধারে সহস্ররে সদা যোগী করে মনন ।।”



তখন তা তত্ত্ব কথা হয়েও বিচিত্র রূপরস সৃষ্টিতে সার্থক হয়ে ওঠে ।


[       ] রামপ্রসাদ তাঁর কোন কোন পদে দেবীর স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়েছেন । সন্তান যেমন মাকে খুঁজে বেড়ায় তিনিও তেমনি নানাভাবে সন্ধান করেছেন । কবি কখন ও কালিকার রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে সতন্ত্র হয়ে প্রশ্ন করেছেন 

              “ ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে 

            গলিত চিকুর আসব আবেশে ।”


অসুর যুদ্ধে কালিকার কালো অঙ্গে রাঙা রক্ত লেগেছে । কবি দেখছেন “ কালিন্দীর জলে কিংশুক ভাসে ।” এ বর্ননা সংযত গম্ভীর এবং বিষয় বস্তুর সম্পূর্ন উপযুক্ত । শেষ পর্যন্ত কবি বলেছেন “ ব্রহ্মময়ী রে করুণাময়ী রে বল জননী ।” কবি দেখেন সমস্ত ভুবন জুড়ে ক্ষেপা মায়ের খেলা চলছে “ এসব ক্ষেপা মায়ের খেলা ।” এই ক্ষেপার খেলায় রামপ্রসাদও যোগ দিয়ে প্রবহমান বিশ্বে ভেলা ভাসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসে আছেন । কবি তীর্থ দর্শন কামনা করেন না , কারণ “ মায়ের পদতলে পড়ে আছে গয়া গঙ্গা বারাণসী ।” কাশিধামে মোহমুক্তি হয় কিন্তু কবি তো মোহ মুক্তির অভিলাশী নন । মাতা পুত্রের বাৎসল্য লীলার স্নেহ মধুর ভাবই তাঁর কাম্য । তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ চিনি হওয়া ভাল নয় মা চিনি খেতে ভালো বাসি ।’ ব্রহ্মময়ীর সাযুয্য লাভ নয় , তাঁর সঙ্গে লিলারসই তাঁর একান্ত কাম্য । 

[       ] কবি অবাধ্য অবশ মনকে তত্ত্বের কশাঘাতে শাসন করতে চেয়েছেন । বিষয় রসে আকন্ঠ মগ্ন পার্থিব মনকে সম্বোধন করে কবি বলেছেন “ ও তোর ঘরে চিন্তমনি নিধি দেখিস না রে বসে বসে ।” তবে বিষয়াসক্ত মনকে তিনি ভৎসনা করতে ছাড়েননি 


  “ রইলি না মন আমার বশে ।

ত্যাজি কমল দলের অমল মধু মত্ত হলি বিষয় রসে ।”


অবশ্য মনের অধোগতির জন্য মনকে দায়ী না করে কবি শ্যামা মায়ের প্রতি অনুযোগ করে বলেন “ তুমি বাজীকরের মেয়ে শ্যামা যেমনি নাচাও তেমনি নাচি ।” এমনি করে অশান্ত দুর্বল মনকে শ্যামা মায়ের চরণে সঁপে দিয়ে কবি নিশ্চিন্ত হয়েছেন । তবে একটু অবহিত হয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে , কবি যে একটি বিশেষ সামাজিক দুর্যোগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা তিনি গোপন করেননি । বিষয় বুদ্ধিতে অপুষ্টিতটার জন্য তাঁর অর্থাভাব কোনদিনই ঘোচেনি । তবু তিনি সান্তনার সুরে বলেছেন “ তুমি এ ভালো করেছো মা আমায় বিষয় দিলে না ।” কখনো সংসারের দুঃখে ব্যাথিত কবি বলেন এই সংসারে সং সাজিতে সার হল গো দুঃখে ভরা ।” কখনো বা আর্তনাদ করে বলেন 

“ মাগো নিম খাওয়ালে চিনে বলে কথায় কর ছলো 

মিঠার লোভে তিত মুখে সারা দিনটা গেল ।”



এখন জীবন প্রান্তে পৌঁছে কবি কি করবেন ? “ এ খন সন্ধ্যা বেলায় ঘরের ছেলে ফিরে চলে ।” রামপ্রসাদ বিশ্বজননীর স্নেহাঞ্চলে ঠাঁই চেয়েছেন । মৃত্যু ভীতিও বিদায় নিয়েছে “ যারে শমন যাবে ফিরে ।”



[        ] রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার একটা কারণ , বাস্তব দুঃখ কে তিনি বৈষ্ণব পদাবলীর মতো সূক্ষ্ম রসে পরিণত করেননি । তাকে স্বীকার করে তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন । দুঃখ বেদনা থেকে পলায়ন নয় , তাঁর দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে নয় আদ্যশক্তির কৃপায় কবি সমস্ত সুখ দুঃখ ত্যাগ করে মুক্তির পথ খুঁজেছেন 

 

                “ আমি কি দুঃখেরে ডরাই ।

            ভরে দাও দুঃখ মা আর কত চাই ।।”


কবি দুঃখের আঘাতে আরও নিবিড় করে জননীকে চিনে নিয়েছেন । এই জন্যই দুঃখ কে নিয়ে তাঁর এত বড়াই । শ্যামার দেওয়া দুঃখ তাঁকে অগ্নিশুদ্ধ স্বর্ণের মতো বিশুধি দান করেছে । কবি দেখিয়েছেন , দুঃখ থেকে একমাত্র পরিত্রাণের পথ শ্যামার চরণে আশ্রয় গ্রহণ । বাঙালী এককথায় বড়ো সান্ত্বনা পেয়েছিল । তাই তাঁর গানের মধ্যে দুঃখ বেদনার কথা থাকলেও সেই দুঃখ বেদনা অতিক্রম করে চিদানন্দময়লোকে উত্তরণ কবির একমাত্র লক্ষ্য । সাধারণ গৃহী মানুষ এ থেকে আশার আলো লাভ করেছে , মুনুক্ষু এ থেকে মোক্ষের প্রাথনা লাভ করেছে , লীলা রসিক এই সমস্ত গানে মাতা পুত্রের বাৎসল্য রসের সম্পর্ক দেখে তৃপ্তি লাভ করে করেছে । এই জন্য বাঙালী জাতির হৃদয়ের সঙ্গে রামপ্রসাদের পদাবলী জড়িয়ে গেছে ।

[        ] রামপ্রসাদের রচনা রীতি সম্পর্কে বলা যায় যে , তাঁর বিভিন্ন পদের অনেক স্থলে অলঙ্কৃত বাকরীতি থাকলেও কবি সাদা সুরে সহজ ভাষায় অধিকাংশ গান রচনা করেছিলেন । সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতায় তাঁর একমাত্র অবলম্বন । দৈনন্দিন জীবিকার প্রতীকই তাঁর তত্ত্ব কথার বাহন হয়েছে । যখন তিনি প্রশ্ন করেন 



               “ বল দেখি ভাই কি হয় মলে ।

               এই বাদানুবাদ করে সকলে ।।”


উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন 


“ প্রসাদ বলে যা ছিল রে তাই হবি রে নিদান কালে 


যেমন জলের বিম্ব জলে উদয় , জল হয়ে সে নেশায় জলে ।”

এই সহজ উপমা রূপক কে তিনি যেভাবে তত্ত্ব কথার নির্দেশ দান করেছেন তাতে তাঁর কবিত্বের বিশেষ প্রশংসা করতে হয় । অবশ্য বৈষ্ণব পদকারের মতো ভাষাও ছন্দের ঝংকার এবং কল্পনার সূক্ষতা তাঁর রচনায় ততটা পাওয়া যায় না । অবশ্য এ শুধু তাঁর একার ত্রুটি নয় , সমস্ত শাক্ত পদাবলীরই এটা একটা সাধারণ লক্ষণ । কবিগণ মূলত সাধক ছিলেন বলেই তত্ত্বের দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন ফলে কাব্য কলার কিছুটা খর্বতা ঘটেছে । রামপ্রসাদ সম্পর্কে সে কথা আংশিক সত্য , তাঁর কয়েকটি পদের রচনা কৌশল , সংযত বাকমূর্তি ও ভাবাবেগে অতি প্রসংশনীয় মনে হলেও বহু স্থলেই পদ গুলি নিতান্ত গতানুগতিক , কৃত্রিম ও রসবর্জিত হয়েছে । তথাপি এই পদে তাপ জজর মানুষের সান্ত্বনার বাণী আছে বলে এর কাব্য মূল্য যেমন হোক না কেন , বাঙালী মানসের এর বিশেষ প্রভাব ও চিরকালীন আবেদনকে অস্বীকার করা যায় না ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন