মেঘ ও রৌদ্র গল্পের নায়ক শশীর চরিত্রের বিশেষত গুলি আলোচনা করো এবং লেখকের শিল্প নৈপুন্যর পরিচয় দাও প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- “ মেঘ ও রৌদ্র ” গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্রটি হল শশীভূষণ । সে এম . এ. বি . এল . ডিগ্রিধারী কিন্তু উপার্জনের আগ্রহী নয় । মানুষের সঙ্গে মেলামেশাতেও সে আগ্রহবোধ করে না । তাই পিতার নির্দেশে সে গ্রামের বিষয় সম্পদ দেখা শোনার উদ্দেশ্য গ্রামেই পড়ে আছে ।
[ ] শশী চোখে একটু কম দেখে । দেখার সময় ভ্রূকুঞ্চিত করে কষ্ট করে দেখে । তাতে গ্রামের মানুষের মনে হয় শশী উদ্বৃত্ত । অহংকারী । সেজন্য গ্রামের মানুষ তাকে পছন্দ করত না । শান্তিপ্রিয় শশিভূষণ বিবাহ করতেও অসম্মতি ছিল , তাই কন্যাদায় গ্রস্ত পিতারাও তাকে অহংকারী মানুষ বলে মনে করতেন । সে সব নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না । সে নিজের ঘর টাতে বসে বেশিরভাগ সময় পাঠে মগ্ন থাকত । আর প্রতিবেশীর মেয়ে দশ বছরের গিরিবালার সঙ্গে একটু আধটু কথা বলত , তাকে পড়াতো , তার দান গ্রহণ করত অর্থাৎ গিরিবালার এনে দেওয়া জাম , পেয়ারা , বকুল ফুলের মালা , ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করে এনে দিলে উপহার স্বরুপ দিলে তা গ্রহণ করত ।
[ ] গ্রামের আর সকলে যখন দলাদলি , চক্রান্ত , ইক্ষুর চাষ , মিথ্যা মোকদ্দমা , পাটের কারবার নিয়ে ব্যস্ত , তখন শশীভূষণ গিরিবালার সঙ্গে কেবল ভাবের আলোচনা আর সাহিত্যচর্চা করে কাটাতো । গিরিবালা ছাড়া গ্রামের আর কোনো মানুষের সঙ্গে শশীভূষণের সুসম্পর্ক ছিল না । কারণ মানুষগুলো আসতো মকদ্দমা ও চক্রান্তের পরামর্শ নিতে , যা দেওয়ার সাধ্য শশীভূষণের ছিল না । আসলে আইন পাশ করা ছেলে হলেও শশী আইনকে কারো অপকর্মের সহায়ক করে তুলতে আগ্রহী ছিল না ; তাই শত্রুকে অন্যায়ভাবে প্যাঁচে ফেলবার পরামর্শ যাঁরা নিতে আসত , তাদের সে ফিরিয়ে দিত । গিরিবালার বাবা নায়েব হরকুমারকেও ফিরিয়ে দেয় । তাই , একটা মামলায় হরকুমার পরাজিত হলে সে শশীভূষণের শত্রু হয়ে যায় তার প্রতিকূলতাতেই শশী কলকাতা চলে যাবার উদ্যোগ করে ।
[ ] কিন্তু এই শশিভূষণই যখন শুনল , জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট বিনা অপরাধে হরকুমারকে প্রকাশ্যে কান ধরে ঘোর দৌড় করিয়েছেন , চরম অপমান করিয়েছেন , তখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বিরুদ্ধে মানহানির মকদ্দমা করার পরামর্শ দিয়েছে এবং নিজে উকিলের ভূমিকা নিয়েছে । ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব শশীবাবুকে নিজের প্রাইভেট কামরায় ডেকে যখন গোপনে মকদ্দমাটা মিটমাট করে নিতে বলেছেন , তখন স্বল্পভাষী শশীভূষণ বলেছে , “ তিনি প্রকাশ্য ভাবে অপমানিত হয়েছেন , গোপনে ইহার মিটমাট হইবে কী করিয়া ।”
[ ] শশীভূষণ সৎ এবং ন্যায় পরায়ন আইন কে ন্যায়ের সহায়ক , অন্যায়ের দন্ডকারক মনে করত । তাই , যে হরকুমার অন্যায় করবার জন্য পরামর্শ চাইতে এসেছিলেন , তাঁকে ফিরিয়ে দিলেও , অন্যায় ভাবে দন্ড প্রাপ্ত ও অপমানিত হরকুমারের পাশে নিজে উপযাচক হিসেবে গিয়ে দাঁড়িয়েছে । হরকুমার প্রথমে খুশি হলেও জমিদার বাবুর চাপে মামলা তুলে নিয়েছে এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট কে উপঢৌকন দিয়ে খুশি করে “ অনরবি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পেয়েছে । শশী ভূষণ সবই বুঝেছে , কিন্তু এতো বড়ো বিশ্বাস ঘাতকের সম্মুখে হাজির হয়ে প্রতিবাদ করেনি ।
[ ] গল্পে আরো দুটো ঘটনার উল্লেখ আছে , যাতে শশীভূষণ দেশীয় মানুষের উপর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে চেয়েছে । সাহেবদের স্টিমারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আগে যাওয়ার অপরাধে সাহেব গুলি করে দেশী নৌকারপাল ফুঁটো করে দেওয়ার নৌকাটা ডুবে যায় , অনেক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে একজনের মৃত্যুও ঘটে । এত বড়ো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহেবের বিরুদ্ধে মকদ্দমা করার পরামর্শ দিল শশীভূষণ । খেসারৎ পাওয়ার লোভে এবং মামলার খরচ লাগবে না জেনে মাঝিরা রাজি হলেও আদালতে বিরূপ সাক্ষী দেওয়ায় মকদ্দমা ডিসমিস হয়ে গেল ।
[ ] আর একবার পুলেশের বড়ো কর্তার নির্দেশে গরিব জেলেদের দামি জাল কেটে দেওয়া হলে এবং নিরপরাধ মানুষকে নৌকায় ধরে এনে নিগ্রহ করলে ন্যায় পরায়ন শশীভূষণ পুলিশের বড়োকর্তার সামনে হাজির হয়ে বলে , “ সার , জেলের জাল ছিঁড়িবার এবং এই চারিজন লোককে উৎপীড়ন করিবার তোমার কোনো অধিকার নাই ।” যথার্থই আইনের কথা , ন্যায়ের কথা ।” কিন্তু আইনের রক্ষক কি আইন মানতে বাধ্য ? পুলিশ এই যুবককে তাচ্ছিল্য হীনভাষায় গালি দেন । তাই , ক্রোদে উম্মত প্রায় হয়ে শশীভূষণ পুলিশকেই প্রহার করে । ফলে তাকে গ্রেফতার করা হয় , নিগ্রহণ করা হয় । অনেকগুলো ধারায় মামলাও রুজু করা হয় । অনেক সাধ্য সাধনায় শশীভূষনের পিতা তাকে জামিনে মুক্ত করলেও , মামলায় হারতে হল ।পুলিশ , ম্যাজিস্ট্রেট , নায়েব হরকুমার সকলের তৎপরতায় দেশের গরীব মানুষ সাক্ষীরা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিল । শশিভূষণের পাঁচ বছরে সাজা হল ।
[ ] জেল থেকে যখন মুক্ত হলো শশীভূষণ , তখন আপনজন বলে তারা আর কেউ নেই । তার পিতার মৃত্যু ঘটেছে । বিষয় সম্পত্তি হরকুমারের দখলে । অসহায় , কর্পদক শূন্য , ক্ষীণদৃষ্টি শশীভূষণ কোথায় যাবে যখন ভেবে পাচ্ছে না , তখন গিরিবালার নির্দেশে তার চাকর এসে গুরু শশীভূষণকে তাঁর বাড়িতেই নিয়ে গিয়েছি । বাবা হরকুমার শশিভূষণের সর্বনাশের কারণ হলেও মেয়ে গিরিবালা তাকে আশ্রয় ও মর্যাদা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইল । সাধা সিধে শশী কোনোদিনই বালিকা প্রণয়নী গিরিবালার মন বুঝতে চায়নি , তাঁর হৃদয়ের গতিপ্রকৃতি , মেঘ ও রৌদ্রের আলো ছায়ার খেলা বুঝতে পারেনি । এখন সেই গিরিবালার ষোলো সতের বছরের বিধবা রমণী । তার সামনে এসে দাঁড়ালে কোনো কথাই উচ্চারণ করতে পারেনি । বাষ্পরুদ্ধ হয়েছে তার কণ্ঠ ।
[ ] রবীন্দ্র সাহিত্যে শশীভূষণ অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র চরিত্র । সে অনেকটা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নায়কের মতো আবেগ সর্বস্ব বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন নয় । অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায় , স্বদেশীদের পাশে দাড়াতেচায় , কিন্তু কি উপায়ে সেটা করা যায় ,সেই বাস্তব বুদ্ধিটুকু তার নেই । লেখক চরিত্রটিকে গাম্ভীর্য দিতে চাননি । কথার মারপ্যাঁচে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটিয়ে তুলেছেন । সংলাপের ব্যবহার খুবই কম । তাই , চরিত্রটি তেমন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারেনি । তবে তার পরিণতি মধ্যে দিয়ে দেশবাসীর ভীরুতা , স্বার্থপরতা , হীনমন্যতা ,আর শক্তিহীন , সহায়হীন , আবেগতাড়িত স্বদেশপ্রেমের পরিণতি বেশ শিল্পনৈপুণ্যের সঙ্গেই দেখানো হয়েছে ।
কোন মন্তব্য নেই