“ টপ ” গল্পে আরণ্যক পরিবেশের বর্ণনায় লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কতদূর সার্থক হতে পেরেছেন , আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- ‘ টপ ’ গল্পের সূচনাতেই লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন গল্পের কাহিনী হল “ আট মাস আগেকার এক আরণ্যক ইতিহাস , একটি বিচিত্র শিকার কাহিনী ।” যে গল্প অরণ্যের শিকার কাহিনী , তাতে অরণ্যের পরিবেশের বর্ণনা থাকার স্বাভাবিক । এ গল্পে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল অরণ্য পরিবেশেরই বর্ণনা । আর সে বর্ণনায় লেখক যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন ।
[ ] রাজাবাহাদুরের পাঠানো রোলস রয়েস গাড়িতে চড়ে স্টেশন থেকে অরণ্যের পথে রওনা হন লেখক । “ পথের দু'পাশে তখন নতুন একটা জগতের ছবি । সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা বাগানের বিস্তার । চকচকে উজ্জ্বল পাতার শান্ত , শ্যামল সুন্দর ।” ফরেস্টে প্রবেশ করে লেখকের বিশেষ অনুভূতি জাগে । শুকনো পাতা মড়মড় শব্দে গুঁড়িয়ে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে , শালের ফুল উড়ে পড়ে গায়ে । বন ময়ূরের ডাক ভেসে আসে কানে । নিবিড় বনের রূপ দেখে লেখকের মনে একটু ভয়ও হচ্ছিল । বনের মধ্যে যদি গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয় , যদি কোনো বুনো জানোয়ার তাঁকে আক্রমণ করে । বাঘ , ভাল্লুক , অজগর সাপ সবই তো এই অরণ্যে আছে ।
[ ] নিবিড় শালবনের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে রাজাবাহাদুরের হান্টিং বাংলো । “ এই নিবিড় জঙ্গলের ভেতরে যেমন আকস্মিক , তেমনি অপ্রত্যাশিত ।” এই বাংলোর স্নানের ঘর , সাজঘর , খাবার টেবিল ইত্যাদির বর্ণনাতেও লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন । তবে রোমাঞ্চের কিছু নেই । বাংলোর জানালা দিয়ে প্রকৃতির যে রূপ তিনি দেখেছেন , তাতে রোমাঞ্চিত না হয়ে পারেননি । জানালার নীচ থেকেই মাটি যেন তিন চারশো ফুট নেমে গিয়েছে । বাংলোটা যেন রাক্ষুসে শূন্যতার উপর ঝুলে রয়েছে । নীচে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল , মাঝ খানে পাহাড়ী নদীর সংকীর্ণ রেখা , দূরে নীল পাহাড়ের প্রহরা । রাজাবাহাদুর অঞ্চলটাকে বলেছেন “ টেরাইয়ের ওয়ান অব দি ফিয়ারর্সেস্ট ফরেস্টস । একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব ।”
[ ] আশ্চর্য সবুজ , আশ্চর্য সুন্দর , রোদ ঝলমল প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে লেখক ভয়ঙ্কর কিছুই দেখেন নি । শিকারের প্রথম রাত্রে , জঙ্গলে গাড়ির মধ্যে বসে শিকার করা দেখেছেন লেখক । গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয়েছে বহুক্ষণ । আলোর বাইরের জঙ্গলটাকে প্রেত পুরীর জমাট বাঁধা অন্ধকার মনে হয়েছে । যেন কাল রাত্রিতে জেগে আছে কালো অরণ্যের প্রাথমিক জীবন । আশ্চর্য স্তব্ধতা , মশার গুঞ্জন , শাল পাতার মর্মর , মাঝে মাঝে বনমুরগীর ডাক , পাখা ঝাপটানো এসব ছাড়া আর কোন অভিজ্ঞতা লেখক পাননি । রাতের অন্ধকার আর দিনের সবুজ অরণ্য দেখা ছাড়া মনে রাখার মতো আর কিছু অরণ্যক ঘটনা লেখকের সামনে উপস্থিত হল না । চতুর্থ দিন সকালে রাজাবাহাদুর লেখককে নিয়ে গিয়েছিলেন হান্টিং বাংলোর পিছন দিকটাতে । সেখানে লেখক একটা নতুন জিনিস দেখেছেন । শূন্যের উপর পনেরো ষোলো হাত প্রসারিত একটি কাঠের পাটাতন দেখতে অনেকটা সাঁকোর মতো । সেখান থেকে দুটো কপিকোলে দুটোই কাছাকাছি ঝোলানো । সাঁকোটার নীচেই পাহাড়ী নদীর রেখা , নুড়ি মেশানো সংকিন বালুতট , তার দুপাশে জঙ্গল আর জঙ্গল । নীচে তাকাতেই লেখকের মাথা ঘুরে যায় । এটা নাকি মাছ ধরবার ব্যাবস্থা ।
[ ] মাছ ধরা দেখবার আকাঙ্ক্ষাতেই লেখক থেকে গেলেন আর একটা দিন । গভীর রাত্রে সেই মাছ ধরা দেখতে গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে । তাঁর মনে হয়েছে , “ সবটা মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাসের পটভূমি তৈরি হয়েছে যেন । অবশ্যই একটা গা ছম ছম পরিবেশ । হান্টিং বাংলোটা অন্ধকার । একটা মৃত্যুর শীতলতা ঢেকে রেখেছে তাকে । একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক চারিদিকে অরণ্যে কান্নার শব্দের মতো পত্রমর্মর । পুঁটলিতে বাঁধা টোপ কপিকলের সাহায্য নামিয়ে দেবার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল । তারপর রজবহাদুরের রাইফেলের গর্জন , তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চারশো ফুট নীচ থেকে উঠে এল প্রচন্ড বাঘের গর্জন । বোঝা গেল , মাছ ধরা আসলে বাঘ শিকার । এই বাঘটারই চামড়ার তৈরী চটিজোড়া ডাক যোগে উপহার স্বরুপ এসেছিল লেখকের কাছে ।
[ ] এ ধরনের গল্পে পরিবেশ বর্ননা টা সার্থক হওয়া জরুরি । আরন্যক পরিবেশকে পাঠকের চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলতে না পারলে এমন গল্প সার্থক হয় না । আর পরিবেশকে বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে ফুটিয়ে তুলতে হলে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যেমন থাকা দরকার , তেমনি থাকা দরকার বর্ণনাকৌশল । নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যাইয়ের এই দুই ই ছিল । তাই , তাঁর এই গল্পের পরিবেশ বর্ননা বাস্তব সম্মত বিশ্বাসযোগ্য এবং আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে ।
কোন মন্তব্য নেই