প্রশ্ন : বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের গদ্য গ্রন্থগুলির পরিচয় দাও ।
উত্তর : যে সব পন্ডিতগণ বাংলা গদ্য রচনায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাজা রামমোহন রায় । শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকই স্বপ্ন , তাঁর বাইরেও নানা বিষয় তিনি পুস্তক রচনা করেন । সেই কারণে রামমোহনের গদ্যভাষা নানা রূপে গুনে সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠা পায় ।
[ ] বলাবাহুল্য তিনিই বাংলার নবজাগরণের প্রথম ও প্রধান পথপ্রদর্শক । ধর্মসংস্কার , কী সম্পদ সংস্কার , কী শিক্ষা সংস্কার সর্বক্ষেত্রেই তাঁর আবেদন অনস্বীকার্য । নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাঁকে পথ চারণা করতে হয়েছে । আবার তিনিই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করেছেন । এই সামাজিক সমস্যা যত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে তাঁর হাতের লেখনী হয়েছে তত বেশি শক্তিশালী । আর সেই লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে বাংলার চিরায়ত গদ্যভাষা । এই গদ্যভাষাই ছিল যে কোন সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রধান মাধ্যম । তাই তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্যভাষা বলিষ্ট ও গতিশীল রূপ পেয়েছিল ।
[ ] রামমোহনের রচিত গ্রন্থগুলি হল ১. বেদান্ত গ্রন্থ , ২. বেদান্ত সার , ৩. পাঁচ টি উপনিষদের অনুবাদ . ৪. সমাজ ধর্মনীতি শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে উক্তি প্রতুক্তিমূলক রচনা :( ক ) উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগিশের সহিত বিচার , ( খ ) ভট্টাচার্যের সহিত বিচার , ( গ ) গোস্বামীর সহিত বিচার , ৫. ব্রথপসনা , ৬ . সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক , ৭. গৌড়ীয় ব্যাকরণ ।
১। বেদান্ত : এটি রাজা রামমোহন রায়ের বেদান্তগ্রন্থের বঙ্গানুবাদ । ভূমিকাংশে তিনি বিরুদ্ধবাদীদের মতকে খন্ডন করে বলেন যে
( ক ) ঈশ্বর নিরাকার হলেও তাঁর উপাসনা করা যায় ।
( খ ) ঈশ্বরের পথ ধরে অন্যান্য যে কোন পথ ত্যাগ করা সম্ভব ।
( গ ) ঈশ্বর অলৌকিক , তাঁর লৌকিক প্রতিমূর্তি পাওয়া সম্ভব নয় ।
বেদান্তগ্রন্থে রামমোহন ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে ব্রহ্মাকেই উপাসনার প্রধান উপাদান বলে মনে করেছেন ।
২। বেদান্তসার : এই গ্রন্থে রামমোহন বেদান্ত গ্রন্থের আসল স্বরূপ বের করে ক্রমান্দয়ে সাজিয়েছেন । এমনকি , তিনি যে এই বিষয়বস্তুকে নতুন করে সাজিয়েছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন । রামমোহন যে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলেছেন , তা তিনি এই গ্রন্থে আরও সহজ করে ব্যাখ্যা করেছেন সাধারনের কাছে । ফলে ব্রহ্মার উপাসনার পথ আরও সহজ হয়েছে ।
৩। উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগিশের সহিত বিচার : রামমোহনের অন্যান্য শাস্ত্রীয় বিচার মূলক গ্রন্থগুলির মধ্যে এটি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য । উৎসবানন্দ নামে এক বৈষ্ণব সাধকের সঙ্গে রাম মোহনের বিতর্কের ভিত্তিতে এই আখ্যায়ীকাটি রচিত । উৎসবানন্দের , মতকে খন্ডন করে রামমোহন প্রমাণ করেন যে , নিরাকার চৈতন্য স্বরূপ পরমব্রহ্মই জগতে একমাত্র সত্য ।
৪। ভট্টাচার্যের সহিত বিচার : এই গ্রন্থ টি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “ বেদান্ত চারিত্রকার ” উপরে লিখিত হয়েছিল । শাস্ত্রীয় যুক্তি তর্কের দ্বারা বিচার করে রামমোহন ভট্টাচার্যের মতবাদকে লঙ্ঘন করেছেন । ভট্টাচার্য মতে পরমাত্মা নিরাবয়ব নন তাঁরও দেহে আছে । এই মতবাদকে রামমোহন স্বীকার করে নিতে পারেননি । নিয়তি এটি ব্যাখ্যা করে বলেন , ঈশ্বর অতীন্দ্রিয় তাঁর প্রতিমূর্তি কখনই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না । এছাড়া তিনি ভট্টাচার্যের প্রতিমা পূজার সপক্ষে যুক্তি লঙ্ঘন করে বলেন , যে সকল ব্যাক্তি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করতে জানে না যে তারা কেবল প্রতিমা পূজাতে লিপ্ত থাকেন ।
৫। সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক - নিবর্তক সম্বাদ এবং সহমরণ বিষয়ক : এই গ্রন্থ তিনটিতে তৎকালীন সমাজ ব্যাবস্থার একটি সুন্দর ছবি ফুটে উঠেছে । এখানে প্রবর্তক ও নীবর্তক দুই শ্রেণীর প্রতিনিধিকে উপস্থাপিত করে সহমরণের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছেন । প্রবর্তক অঙ্গিরা ঋষির মত পোষণ করে সহমরণের পবিত্রতাকে প্রমাণ করেছেন । অন্যদিকে নীবর্তক মনু , যাজ্ঞবল্ক এই সমস্ত ঋষির কথা উল্লেখ করে সহমরণের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে ।
[ ] সহমরণ সম্বন্ধে দ্বিতীয় গ্রন্থে রামমোহন মানবিকতার কথা ভুলে সহমরণের পক্ষে যুক্তি দেখান । সহমরণ বিষয়ক তৃতীয় গ্রন্থে রামমোহন বিপ্রনামা ও মুগ্ধবোধ ছাত্র নামে দুটি চরিত্রের মুখ দিয়ে সহমরণ বিষয়ক যুক্তি তর্কের অবতারণা ঘটিয়েছেন । গীতাতেও যে সহমরণ কার্যের বিরুদ্ধে নিষেধ আছে তা তিনি বিপ্রনামা চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন