নীল ধ্বজের প্রতি জনা পত্রটি বিশ্লেষণ করে জনার মাতৃত্ববোধের স্বরুপ নির্ণয় করো প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- “ নীল ধ্বজের প্রতি জনা ” পত্রটি কাশীরাম দাসের মহাভারত । এখানে আছে মাতিম্মতি রাজ নীলধ্বজের স্ত্রী জনার কথা । গঙ্গা ভক্ত জনার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করে প্রবীর । পাণ্ডবদের অশ্বমেধের ঘোড়া পুত্র প্রবীর বন্দি করেছিল । কৃষ্ণভক্ত নীলধ্বজ সেই ঘোড়া ফিরিয়ে দিতে বললে পুত্র প্রবীর ফেরত না দিয়ে মাতা জনার অনুপ্রেরণায় অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যুদ্ধে প্রবীর মৃত্যুবরণ করে । তখন স্বয়ং জনা যুদ্ধে অগ্রসর হলে কৃষ্ণের কৌশলে পান্ডবরা রক্ষা পায় । পুত্রশোকে অধীর হয়ে জনা গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয় ।
[ ] মধুসূদন জনার এই কাহিনীকে অবলম্বন করেছেন তার পত্রে । গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে সমস্ত জ্বালা জুড়াবার পূর্ব মুহূর্তের পত্র এটি । অর্জুনের ওপর রাগ স্বামীর প্রতি অভিমান এবং পুত্র প্রবীরের প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাৎসল্য । স্বামীর প্রতি দোষারোপ করা যে পাপ সে কথাও উল্লেখ করেছেন স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই
[ ] জনা পত্রিকার ছত্রে মর্ম পীড়িত নারী হৃদয়ের জ্বালা ও অভিমান ফুটে উঠেছে । পুত্রের মৃত্যুতে জনার বিলাসে পুত্র শোকাতুরা জননীর বিলাপ অশ্রু নেই আছে শুধু অগ্নিময়ী প্রবাহ । কাব্যেৎকর্ষের বিচারে , এই পত্রিকাটি সর্বাঙ্গ সুন্দর এবং আবেদন মর্মভেদী । অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে পুত্র প্রবীর নিহত হওয়ার সত্ত্বেও রাজা নীলধ্বজ ক্ষত্রধর্ম বিস্তৃত হয়ে সেই অর্জুনের সঙ্গে সখত্যা স্থাপন করে হস্তিনাপুরে যেতে চাইছেন । রাজপুরীতে বিশেষ সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছেন । স্বামীর বিসদৃশ আচরণে ব্যাথিত জনার হৃদয়ে প্রতিশোধানল প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল । অর্জুন অন্যায় সমরে বালক প্রবীরকে নিহত করেছেন কোথায় শত্রুর রক্তে শোক নির্বাপিত হবে তা না করে নীলধ্বজ অর্জুনের মনোরঞ্জনের জন্য রাজসভায় নৃত্য গীতাদির আয়োজন করেছেন ।
[ ] গঞ্জনায় তিরস্কারে জনা অর্জুনের অন্যায় যুদ্ধ ও চারিত্রিক দুর্বলতা কথা শুনিয়ে দিলেন স্বামীকে । তবুও সংশয় থাকায় জনা পুঞ্জিভূত ক্রোধে ফেটে পড়লেন তিনি । কুন্তী দ্রোপদী ও ব্যসদেব সহ অর্জুনের জন্ম ও চরিত্রগত কলঙ্কের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন
“ নরণারায়ন পার্থ ! কুলটা যে নারী
বেশ্যাগর্ভে তার কী হে জনমীলা আসি ।”
প্রবীরের মৃত্যুতে নীলধ্বজ উদাসীন । পুত্রশোকে অধীর । কিন্তু তার চেয়েও বেশি অধীর হয়েছেন স্বামীর আচরণ । জনার মধ্যে স্বাধীন চিন্তাশক্তির প্রকাশ ঘটতে আমরা দেখি । প্রচলিত ও সর্বজন স্বীকৃত মতামতকে নির্দ্বিধায় মেনে নেননি তিনি । উনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ আত্মমর্যাদা এবং যুক্তিবাদী বিশ্লেষণধর্মী প্রবণতা দেখা যায় জনা চরিত্রে । পান্ডবদের সর্বস্বীকৃত দেবত্বে তিনি অবিশ্বাসী ব্যসদেবও তাঁর তীক্ষ্ণ যুক্তিজালে জজরিত । অর্জুনের বীরত্ব খ্যাতির বিরূদ্ধেও জনার বক্তব্য যুক্তিযুক্ত
ছদ্মবেশে লক্ষ রাজে দলিল দুর্মতি
স্বয়ম্বরে ! যথা সাধ্য কে যুঝিল কহ ,
ব্রাহ্মণ ভাবিয়া তারে , কোনো ক্ষত্ররথী ,
সে সংগ্রামে ? রাজদল তেই সে জিতিল ।
এছাড়া কৃষ্ণের সাহায্য খাণ্ডব দহন , কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শ্রীখন্ডি সাহায্য ভীষ্ম নিধন , অন্যায় যুদ্ধে কর্নবধ প্রভৃতি যুদ্ধ কি নীতিসম্মত । “ কহ মোরে শুনি মহারথী প্রথা কি হে এই মহারথী ?” তেজস্বিনী ক্ষাত্র ধর্মের দৃপ্ত প্রতিমা জনা । পুত্র শোকে তাঁর অন্তর দিবির্ন হয়ে যাচ্ছে তাই শোকে স্বামী নীলধ্বজকে জনা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উত্তেজিত করেছেন ।
কিন্তু ক্ষাত্র ধর্মের উদবুদ্ধ করতে ব্যার্থ জনা ক্ষোভে লজ্জায় ঘৃণায় আহত সপিনির মতো গর্জন করে উঠলেন ।
“ কী লজ্জা ! দুঃখের কথা হায় কব কারে ?”
স্বামী কৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ভক্তির পথে চলেছেন আর র্জনা চলেছেন বীরের পথে । বিদ্রোহীনি জনা জানেন স্বামীর কাজ ক্ষাত্রধর্মী বিরোধী । পতি পরায়না স্ত্রী তাই রাজ পুর তথা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে দৃঢ প্রতিজ্ঞ । অধর্ম ও অকর্তব্য থেকে স্বামীকে উদ্ধার করতে পারেননি । তাঁর নিরুদ্ধ অশ্রুর মধ্যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়েছে ।
“ ফিরি যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি ,
নরেশ্বর , ‘ কোথা জনা ?’ বলি ডাক যদি
উত্তরিবে প্রতিধ্বনি ‘ কোথা জনা ?’ বলি ।”
জনা কিন্তু কৈকেয়ীর মতো স্বামীকে অপমানিত করেননি । কেবল দুঃখে ও মর্মবেদনার জ্বালায় হাহাকার করেছেন । স্বামীর প্রতি ভক্তি ছিল জনার আন্তরিকা । তাই স্বামী ভক্ত জনা বলেন
“ গুরুজন তুমি
পরিব বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে ।”
এখানে মধুকবির নৈপুণ্যের তুলনা নেই । জনার একটি উচ্চাঙ্গের বীরাঙ্গনা রূপ এ পত্রিকায় গাঢ উজ্জ্বল বর্ণে অঙ্কিত হলেও তাঁর নারী রূপ যেন সাম্যক বিকশিত হয়নি । কিন্তু পত্রের শেষ অংশে চমৎকার নাটকীয় উপসংহারে চরিত্রটি অপরূপ হয়ে উঠেছে । এখানে আমাদের মনে পরে যায় , জনা চিরন্তন ভারতীয় নারীর স্বামীর চরণে বিদায় প্রাথনা না করে মহাযাত্রায় যেতে পারেন না তিনি । তিনি অভিমানবশে প্রাণ বিসর্জনের জন্য রাজপুরী ত্যাগ করেছেন বটে , কিন্তু স্বামীর জন্য তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে । শূন্য ঘরে “ কোথা জনা ” বলে ডেকে রাজা যখন কেবল প্রতিধ্বনিই শুনতে পারেন , স্বামীর তখন কার সেই মমবেদনা অনুমান করে এই নারী অশ্রু সম্বরণ করতে পারছেন না , এখানেই জনার এই এক চিরন্তন সকরুণ নারী রূপ পাঠকের মানস পটে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ।
কোন মন্তব্য নেই