উত্তর:- কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র অনেকগুলি গল্পও লিখেছেন । তাঁর একটি বিশিষ্ট এবং জনপ্রিয় গল্প হল “ তেলেনাপোতা আবিষ্কার ” । বিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপনাভঙ্গীর দিক থেকে গল্পটি যেমন অভিনব , তেমনি এ গল্পের অর্থ বোঝা যায় । কিন্তু , আলোচ্য গল্পটির ভাষা তেমন সহজ সরল নয় , আবার দুর্বোধ্যও নয় । একটু মনোযোগী হলেই ভাষার উপলবব্ধ হয় । তাতে গল্পের রস আরো বেশি আস্বাদনীয় হয়ে ওঠে । এখানেই গল্পের কাব্যে লক্ষণ ফুটে ওঠে ।
[ ] গল্পটির মধ্যে এমন বহু উক্তি আছে , যাকে গদ্য কবিতার বিষয় মনে হয় ভাষার কারণেই । যেমন গল্পের সূচনাতেই লেখা হয়েছে “ আর যদি কেউ ফুসলানি দেয় যে , কোনো এক আশ্চর্য সরোবরে পৃথিবীর সবচেয়ে সরলতম মাছেরা এখনো তাদের জল জীবনের প্রথম বড়শিতে হৃদয় বিদ্ধ করবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে , আর জীবনে কখনো কয়েকটা পুঁটি ছাড়া অন্য কিছু জল থেকে টেনে তোলার সৌভাগ্য যদি আপনার না হয়ে থাকে , তাহলে একদিন তেলেনাপোতা আপনিও আবিষ্কার করতে পারেন ।” এ যে শুধু জলের মাছের কথা নয় মানুষ মাছের কথাও এর মধ্যে বলা হয়েছে তা বোঝা যায় । আর সেখানেই কথাগুলোর ব্যঞ্জনা সার্থক হয় । কথাগুলো কাব্য হয়ে ওঠে ।
[ ] এই ব্যঞ্জনাকে আশ্রয় করেই গল্পের কাহিনী পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে । গল্পে একজন মৎস্য শিকার যুবক আছে সে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়েই কলকাতা থেকে তেলেনাপোতায় এসেছে । সে সকাল বেলা সেই সরঞ্জাম নিয়ে পুকুরে গিয়ে ছিপ ফেলে বসেছেও । কিন্তু মাছ একটাও বাঁধতে পারেনি । এই জলের মাছ ধরার চেষ্টার পাশাপাশি ডাঙার মাছ সহজ সরল , দরিদ্র অসহায় , গ্রাম্য যুবতী মৎসের হৃদয় বিদ্ধ করার চেষ্টাও হয়েছে । তাতে শহরের যুবকটি ব্যর্থ হয়নি । গ্রাম্য মেয়ে যামিনী কে ভালোবাসার সুতো বড়শিতে গেঁথে ফেলেছেন ।
[ ] যামিনী এক অসহায় , দরিদ্র , প্রেম শুন্য , ভরসাহীন যুবতী নারী , যার বিবাহ হয়নি । সহায়হীন দরিদ্রের মেয়েকে , “ ঘুটে কুরুনী মেয়েকে ” কে উদ্ধার করবে । নিরঞ্জন নামের কোনো এক যুবক কথা দিয়েও হতাশায় ডুবিয়ে চলে গিয়েছে । তাই , কারো প্রেমের বড়শিতে যামিনীর হৃদয় বিদ্ধ হয়নি । পুকুরঘাটে মাছ ধরার সাধনায় রত যুবক । জল আনতে ঘাটে যাওয়া যামিনী কে দেখে । নিঃসঙ্কোচ , শান্ত প্রকৃতির , দ্বিধাহীনা সে আসে অচেনা শহুরে যুবকের সঙ্গে কথাও বলে । ফাৎনা ডুবলেও ছিপে টান না দেওয়ায় , যামিনী বলে , “ বসে আছেন কেন ? টান দিন ।”
[ ] ছিপের সুতোয় টান দিয়ে জলের মাছ ডাঙায় তোলা না গেলেও সরল , গ্রাম্য , যুবতী যামিনী কে পূর্বরাগ বড়শীতে গাঁথতে পেরেছে । যামিনীর বৃদ্ধা , অন্ধর , পঙ্গু মায়ের হতাশা দূর করতে তার ঘরে গিয়ে , নিরঞ্জনের ভূমিকা নিয়ে মিথ্যা করে বলেছে , সে আর পালাবে না । যামিনী কে বিবাহ করার কথা জানতে চাইলে বলেছে “ আমি তোমায় কথা দিচ্ছি মাসি মা । আমার কথার নড়চড় হবে না ।” এরপরও কি শহুরে যুবকের বড়শিতে যামিনীর হৃদয় বিদ্ধ না হয়ে থাকে , সেই সত্যটিও লেখক প্রকাশ করেছেন কাব্যে ভাষায় “ ঠোঁট থেকে নয় , মনে হবে , তার চোখের ভেতর থেকে মধুর একটি সকৃতজ্ঞ হাসি শরতের শুভ্র মেঘের মতো আপনার হৃদয়ের দিগন্ত স্নিগ্ধ করে ভেসে যাচ্ছে ।”
[ ] গল্পের কাহিনী আর ঘটনা বর্ণনায় এই রকম কাব্য ভাষা প্রায় সর্বত্র ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন রাতের ভবনের ছাদে উঠে পাশের ঘরের জানলায় রাত্রে ভগ্ন ছাদে উঠে পাশের ঘরের জানালায় দামিনীকে প্রথমবার আবছা আলোয় দেখে শহুরে যুবকের মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল , ভাবনার উদয় হয়েছিল “ কিন্তু কিছুই বুঝতে পারবেন না । খানিক বাদে মনে হবে সবই বুঝি আপনার চোখের ভ্রম । বাতায়ন থেকে সে ছায়া সরে গেছে , আলোর ক্ষীণ রেখা গেছে মুছে । মনে হবে এই ধ্বংস পুরীর অতল নিদ্রা থেকে একটি স্বপ্নের বুদবুদ ক্ষণিকের জন্য জীবনের জগতে ভেসে ওঠে আবার বিস্তৃত । আশা জাগিয়ে শহরে ফিরে আর আসে নি । যামিনী তাঁর স্মৃতি থেকে ক্রমশ মুছে গেছে । গল্পে সমাপ্তিতে লেখক কাব্য ভাষাতেই সেকথা জানিয়েছেন , “ অস্ত যাওয়া তারার মতো তেলেনাপোতার স্মৃতি আপনার কাছে ঝাপসা একটা স্বপ্ন বলে মনে হবে । মনে হবে তেলোনপোতা বলে কথাও কিছু সত্যিই নেই । গভীর কঠিন গভীর কঠিন যার মুখ আর দৃষ্টি যার সুদুর ও করুণ , ধ্বংস পুরীর ছায়ার মতো সেই মেয়েটি হয়তো আপনার কোনো দুর্বল মুহূর্তের অবাস্তব কুয়াশাময় কল্পনা মাত্র ।”
[ ] গল্পের বিষয় কে এমন কাব্যময় ব্যঞ্জনা ধর্মী ভাষায় উপস্থাপনা করা সহজ নয় , প্রেমেন্দ্র মিত্র তা পেরেছেন । ভাষার গুণেই গল্পের আকর্ষণ আর কাব্যের চমৎকারিত্ব পাঠককে টেনেছে । বিষয় অবগতির গতি হয়তো মন্থর , কিন্তু উপভোগ্যতা অবশ্যই বেশী । এই জন্য “ তেলেনাপোতা আবিষ্কার ”বাংলা ছোট গল্পের ধারায় একটি বিশিষ্ট গল্প হয়ে উঠতে পেরেছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন