শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২১

“ তেলেনাপোতা আবিষ্কার ” গল্পের কথা সাহিত্যের লক্ষনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে কাব্যেলক্ষণ । আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর

 

বাংলা অনার্স সাম্মানিক bengali honours তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের কথা সাহিত্যের লক্ষনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে কাব্যেলক্ষণ আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর telenapota abishkar golper kotha sahiter lokhoner songe mishe giyeche kabbo lokhon alochona koro questions answer

উত্তর:- কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র অনেকগুলি গল্পও লিখেছেন । তাঁর একটি বিশিষ্ট এবং জনপ্রিয় গল্প হল “ তেলেনাপোতা আবিষ্কার ” । বিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপনাভঙ্গীর দিক থেকে গল্পটি যেমন অভিনব , তেমনি এ গল্পের অর্থ বোঝা যায় । কিন্তু , আলোচ্য গল্পটির ভাষা তেমন সহজ সরল নয় , আবার দুর্বোধ্যও নয় । একটু মনোযোগী হলেই ভাষার উপলবব্ধ হয় । তাতে গল্পের রস আরো বেশি আস্বাদনীয় হয়ে ওঠে । এখানেই গল্পের কাব্যে লক্ষণ ফুটে ওঠে ।

[       ] গল্পটির মধ্যে এমন বহু উক্তি আছে , যাকে গদ্য কবিতার বিষয় মনে হয় ভাষার কারণেই । যেমন গল্পের সূচনাতেই লেখা হয়েছে “ আর যদি কেউ ফুসলানি দেয় যে , কোনো এক আশ্চর্য সরোবরে পৃথিবীর সবচেয়ে সরলতম মাছেরা এখনো তাদের জল জীবনের প্রথম বড়শিতে হৃদয় বিদ্ধ করবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে , আর জীবনে কখনো কয়েকটা পুঁটি ছাড়া অন্য কিছু জল থেকে টেনে তোলার সৌভাগ্য যদি আপনার না হয়ে থাকে , তাহলে একদিন তেলেনাপোতা আপনিও আবিষ্কার করতে পারেন ।” এ যে শুধু জলের মাছের কথা নয় মানুষ মাছের কথাও এর মধ্যে বলা হয়েছে তা বোঝা যায় । আর সেখানেই কথাগুলোর ব্যঞ্জনা সার্থক হয় । কথাগুলো কাব্য হয়ে ওঠে ।

[      ] এই ব্যঞ্জনাকে আশ্রয় করেই গল্পের কাহিনী পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে । গল্পে একজন মৎস্য শিকার যুবক আছে সে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়েই কলকাতা থেকে তেলেনাপোতায় এসেছে । সে সকাল বেলা সেই সরঞ্জাম নিয়ে পুকুরে গিয়ে ছিপ ফেলে বসেছেও । কিন্তু মাছ একটাও বাঁধতে পারেনি । এই জলের মাছ ধরার চেষ্টার পাশাপাশি ডাঙার মাছ সহজ সরল , দরিদ্র অসহায় , গ্রাম্য যুবতী মৎসের হৃদয় বিদ্ধ করার চেষ্টাও হয়েছে । তাতে শহরের যুবকটি ব্যর্থ হয়নি । গ্রাম্য মেয়ে যামিনী কে ভালোবাসার সুতো বড়শিতে গেঁথে ফেলেছেন ।

[       ] যামিনী এক অসহায় , দরিদ্র , প্রেম শুন্য , ভরসাহীন যুবতী নারী , যার বিবাহ হয়নি ।  সহায়হীন দরিদ্রের মেয়েকে , “ ঘুটে কুরুনী  মেয়েকে ” কে উদ্ধার করবে । নিরঞ্জন নামের কোনো এক যুবক কথা দিয়েও হতাশায় ডুবিয়ে চলে গিয়েছে ।  তাই , কারো প্রেমের বড়শিতে যামিনীর হৃদয় বিদ্ধ হয়নি । পুকুরঘাটে মাছ ধরার সাধনায় রত যুবক । জল আনতে ঘাটে যাওয়া যামিনী কে দেখে । নিঃসঙ্কোচ , শান্ত প্রকৃতির , দ্বিধাহীনা সে আসে অচেনা শহুরে যুবকের সঙ্গে কথাও বলে । ফাৎনা ডুবলেও ছিপে টান না দেওয়ায় , যামিনী বলে , “ বসে আছেন কেন ? টান দিন ।”

[      ] ছিপের সুতোয় টান দিয়ে জলের মাছ ডাঙায় তোলা না গেলেও সরল , গ্রাম্য , যুবতী যামিনী কে পূর্বরাগ বড়শীতে গাঁথতে পেরেছে । যামিনীর বৃদ্ধা , অন্ধর , পঙ্গু মায়ের হতাশা দূর করতে তার ঘরে গিয়ে , নিরঞ্জনের ভূমিকা নিয়ে মিথ্যা করে বলেছে , সে আর পালাবে না  । যামিনী কে বিবাহ করার কথা জানতে চাইলে বলেছে “ আমি তোমায় কথা দিচ্ছি মাসি মা ।  আমার কথার নড়চড় হবে না ।” এরপরও কি শহুরে যুবকের বড়শিতে যামিনীর হৃদয় বিদ্ধ না হয়ে থাকে  , সেই সত্যটিও লেখক প্রকাশ করেছেন কাব্যে ভাষায় “ ঠোঁট থেকে নয় , মনে হবে , তার চোখের ভেতর থেকে মধুর একটি সকৃতজ্ঞ হাসি শরতের শুভ্র মেঘের মতো আপনার হৃদয়ের দিগন্ত স্নিগ্ধ করে ভেসে যাচ্ছে ।”

[     ] গল্পের কাহিনী আর ঘটনা বর্ণনায় এই রকম কাব্য ভাষা প্রায় সর্বত্র ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন রাতের ভবনের ছাদে উঠে পাশের ঘরের জানলায় রাত্রে ভগ্ন ছাদে উঠে পাশের ঘরের জানালায় দামিনীকে প্রথমবার আবছা আলোয় দেখে শহুরে যুবকের মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল , ভাবনার উদয় হয়েছিল “ কিন্তু কিছুই বুঝতে পারবেন না । খানিক বাদে মনে হবে সবই বুঝি আপনার চোখের ভ্রম । বাতায়ন থেকে সে ছায়া সরে গেছে , আলোর ক্ষীণ রেখা গেছে মুছে । মনে হবে এই ধ্বংস পুরীর অতল নিদ্রা থেকে একটি স্বপ্নের বুদবুদ ক্ষণিকের জন্য জীবনের জগতে ভেসে ওঠে আবার বিস্তৃত ।  আশা জাগিয়ে শহরে ফিরে আর আসে নি । যামিনী তাঁর স্মৃতি থেকে ক্রমশ মুছে গেছে । গল্পে সমাপ্তিতে লেখক কাব্য ভাষাতেই সেকথা জানিয়েছেন , “ অস্ত যাওয়া তারার মতো তেলেনাপোতার স্মৃতি আপনার কাছে ঝাপসা একটা স্বপ্ন বলে মনে হবে । মনে হবে তেলোনপোতা বলে কথাও কিছু সত্যিই নেই । গভীর কঠিন গভীর কঠিন যার মুখ আর দৃষ্টি যার সুদুর ও করুণ , ধ্বংস পুরীর ছায়ার মতো সেই মেয়েটি হয়তো আপনার কোনো দুর্বল মুহূর্তের অবাস্তব কুয়াশাময় কল্পনা মাত্র ।”

[       ] গল্পের বিষয় কে এমন কাব্যময় ব্যঞ্জনা ধর্মী ভাষায় উপস্থাপনা করা সহজ নয় , প্রেমেন্দ্র মিত্র তা পেরেছেন । ভাষার গুণেই গল্পের আকর্ষণ আর কাব্যের চমৎকারিত্ব পাঠককে টেনেছে । বিষয় অবগতির গতি হয়তো মন্থর , কিন্তু উপভোগ্যতা অবশ্যই বেশী । এই জন্য “ তেলেনাপোতা আবিষ্কার ”বাংলা ছোট গল্পের ধারায় একটি বিশিষ্ট গল্প হয়ে উঠতে পেরেছে ।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন