“ জলসাঘর ” গল্পে মহিম গাঙ্গুলী চরিত্রটি কতটা গুরুত্ব পেয়েছে এবং সৃষ্টি হিসেবে কতটা সার্থকতা লাভ করেছে , আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ জলসাঘর ’ গল্পের একটি প্রয়োজনীয় পার্শ্ব চরিত্র মহিম গাঙ্গুলী । গল্পের যেটা বক্তব্য , সেটা স্পষ্ট করে তুলতে এ চরিত্রটি অপরিহার্য ছিল । এগল্পের মূল বিষয় হলো ধণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামন্ততন্ত্রের অবলুপ্তি । সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা পক্ষের প্রতিভূ হলেন মহিম গাঙ্গুলী । মহাজনি ব্যবসার মাধ্যমে তিনি অশেষ ধরনের অধিকারী হয়েছেন , আর ধনের প্রাচুর্য্যই তার মনে জাগিয়ে তুলেছে অহংকারবোধ । গল্পে আমরা যে কবারই মহিম গাঙ্গুলীর সাক্ষাৎকার পাই , প্রতিবারই তার কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কিছু না কিছু অহংকারের প্রকাশ ঘটতে দেখি ।
[ ] মহিম গাঙ্গুলী প্রচুর ধরনের অধিকারী হলেও মনটা উদার ছিল না তার । যথেষ্ট ঈর্ষাপরায়ণ এবং ক্রু ছিলেন । আর্থিক দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জমিদার রায় বংশের সপ্তম পুরুষ বিশ্বম্ভর রায়কে মানুষ হুজুর বলত , অথচ , মহিমকে কেউ তেমন খাতির করত না । এটা মহিমের ভালো লাগতো না । হিংসে হত । সেই হিংসা বশতই তিনি যে কোনো ছুতোয় রায় মশাইকে আঘাত করতে চাইতেন । তার যে হুজুর তার যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই , এ কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর তৃপ্তি অনুভব করতেন ।
[ ] ছেলের মুখেভাত উপলক্ষে বিপুল আয়োজন করেছেন লখনৌ থেকে দুইজন বাইজি আনিয়ে জলসার ব্যবস্থা করেছেন । সেই জলসায় রায় মশাইকে নিমন্ত্রণ করবার জন্য মহিম নিজে গিয়েছেন রায়বাড়ীতে । বলেছেন “ রাত্রে পায়ের ধুলো দিতেই হবে । ... শখ করে লখনৌ থেকে বাইজী আনিয়েছি । তাদের গানের কদর আপনি ভিন্ন আমরা বুঝব না ।” রায়মশাই যেতে পারবে না জানালে মহিম গাড়ী পাঠাবার প্রস্তাব দিয়েছেন । ফেরার সময় এমন সব কথাবার্তা বলেছেন যে আপাতত দৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হলেও কথাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল রায়মশায়ের অন্তরের জ্বালা ধরানো । তাঁর ,গাড়ি আছে সদরের সাহেব সুবদের সঙ্গে দহরম আছে , লখনৌ বাইজিদের পেছনে টাকা ঢালবার সামর্থ্য আছে , বিশ্বম্বরের এসব কিছুই নেই , তিনি সামর্থ্যহীন নিঃস্ব । মহিমের বাবা জনার্দনও রায় মশাই কে হুজুর বলে সম্মান করছেন , কিন্তু মহিম ‘ হুজুর ’ শব্দটি ব্যবহার করেন না , রায়মশাই কে বলেন ‘ ঠাকুরদা ’।
[ ] বৃদ্ধ হয়েছেন , শরীর নিয়মের ব্যতিক্রম সয় না , এই সব অজুহাত দেখিয়ে বিশ্বম্বর মহিমের বাড়িতে খেতে এবং বাইজিদের নৃত্যগীত । নিষ্ঠুর মহিম রায়মশাই কে বিড়ম্বনার মধ্যে ঠেলে দিয়ে মোজা উপভোগ করতে চাইলেন । বিদায়ের দিন বাইজিদের বিদায় করে বলে দিলেন , রায় বাড়ি ঘুরে যেতে । “ বিশ্বম্বর রায় সমঝদার আমির লোক । গাওনা হয়তো হতে পারে ।” নিঃস্ব বিশ্বম্বর বাইজীদের মজুরী দিতে পারবেন না । আবার গাওনা না করে ফিরিয়ে দেবার লজ্জাও সইতে পারবেন না । গাঙ্গুলীর এই কুট চাল নায়েব তারাপ্রসন্ন যেমন বুঝেছেন , পাঠকেরা ও বুঝেছেন । কিন্তু মহিমের দেওয়া এই যন্ত্রণার পরিণতি রায় মশায়ের পক্ষে ভয়ংকর হয়েছে ।
[ ] রায় মহাশয় বাইজিদের ফেরান নি । সর্বস্বের বিনিময়ে রায়বংশের মর্যাদা রাখতে জলসাঘরে জলসার আয়োজন করেছেন । সেখানে মহিম গাঙ্গুলীরও নিমন্ত্রণ হয়েছে । মহিম জলসা ঘরে উপস্থিত হয়ে কেবল নিজের চাকচিক্যের ফিরিস্তি দিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন । রায়বাড়ীর , সাবেক আভিজাত্যপূর্ণ আসবাবগুলিকে উপহাস করতে চেয়েছেন । ঘরে আলো কম বলে নায়েব তারাপ্রসন্ন কে বলেছেন , “ দেখুন আলো , বেশ খোলে নি । আমার ড্রাইভার কে বলে দিন , দুটো পেট্রোম্যাক্স নিয়ে আসুক ।” তাকিয়ায় ধূলো বলে ঘৃণাভরে সরিয়ে দিয়েছেন । মজলিস চলার সময় মনিবের আগেই বাইজিকে বখশিস দেবার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছেন ।
[ ] এই সব কারণ থেকেই বোঝা যায় , মহিমের অহংকার তারা শিষ্টতাকে ঘুছিয়ে দিয়েছে । শিষ্টতার অভাবও ধনতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য । এ গল্পের মহিম চরিত্রটি ধনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলিকেক যেন ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেছে আর তারই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্বম্বর রায়ের চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছে । অর্থাৎ , এ গল্পের বক্তব্য প্রতিষ্ঠানয় মহিম গাঙ্গুলী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ।
কোন মন্তব্য নেই