সোমবার, ২২ নভেম্বর, ২০২১

“ প্রাগৈতিহাসিক ” গল্পের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা করো এবং গল্পের নামকরণ সার্থকতা নির্দেশ করো প্রশ্নোত্তর

 

বাংলা অনার্স সাম্মানিক bengali honours প্রাগৈতিহাসিক গল্পের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা করো এবং গল্পের নামকরণ সার্থকতা নির্দেশ করো প্রশ্নোত্তর progroitikhasik golper bishoy bostu songkhepe alochona koro abong golper namkoron sarthokota nirdesh koro questions answer

উত্তর:- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত ছোটগল্প “ প্রাগৈতিহাসিক ” ।  একটি বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় গল্পগুলো বলেই বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে । গল্পের বিষয় যেমন অভিনব এবং চমকপ্রদ , তেমনি এর নামকরণও তাৎপর্যপূর্ন এবং আকর্ষণীয় । সাহিত্যে নামকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । বস্তু জগতে নাম নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে । কিন্তু শিল্প জগতে , সৃষ্টির জগতে সৃষ্টির একটা উপযুক্ত নাম না  থাকলে চলে না । তাই , যে কোন সাহিত্যিক তাঁর যেকোনো শাখার সৃষ্টির উপযুক্ত একটা নাম দিতে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেন ।

[      ] আখ্যান জাতীয় রচনার নামকরণ করা হয় রচনার বিষয়ের বা ঘটনার উপর ভিত্তি করে , প্রধান চরিত্রের নামানুসারে এবং রচনার লক্ষ্যবস্তু বা অভিপ্রায়কে ইঙ্গিত করে । শেষের প্রথায় নামকরণ হলে তাকে বলা হয় ব্যঞ্জনধর্মী নামকরণ । এই নামকরণকেই উৎকৃষ্ট নামকরণ বলে গণ্য করা হয় । আমাদের আলোচ্য “ প্রগৈতিহাসিক ” গল্পের নামকরণ ব্যঞ্জনধ্বনি। তাই  উৎকৃষ্টও বটে । এ খন আমরা দেখব , গল্পের বিষয়ের সঙ্গে , লক্ষ্যবস্তু বা অভিপ্রেত ভাবের ও বক্তব্যের সঙ্গে এই নামকরণের সঙ্গতি আছে কিনা ।


[      ] মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ প্রাগৈতিহাসিক ’ গল্পে বেশী চরিত্র সৃষ্টি করেন নি । ঘটনাবহুল্যও নেই । ভিখু , পেহলাদ , পাঁচী আর বসির এই চারটিমাত্র চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক আদিম কিছু প্রবৃত্তিরপরিচয় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন । প্রধান চরিত্র ভিখুই লেখকের সেই ইচ্ছা পূরণের প্রধান সহায়ক । ভিখু পেশায় ডাকাত । একেবারেই হৃদয়হীন । জৈব ক্ষুধা ছাড়া তাঁর কোনো মনের ক্ষুধা নেই । সে কাউকে ভালবাসতে জানে না , কারো ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তার নেই । পেটের খিদে শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য রসদ লাগে । তার জন্যই সে ডাকাতি করে , ছিনতাই করে , প্রয়োজনে খুন করতে দ্বিধা করে না ।

[       ] কোনো রকম শিক্ষা , রুচি , সংস্কৃতি চেতনা , পাপ পুণ্য , ন্যায়-অন্যায়বোধ , অপরাধবোধ , মনুষ্যত্ব ,  প্রেম প্রীতি স্নেহ ,  মমতা ভিখুর চরিত্রে কোনো কালেও ফুটো ওঠেনি । সে কেবল পেটে খেতে চায় , নারীর সঙ্গ চায় , আর বেঁচে থাকতে চায় । তার চাওয়ার সঙ্গে একটা পশুর চাওয়ার কোন পার্থক্য নেই । পশুর প্রবৃত্তি যেমন আদিম , প্রগৈতিহাসিক , তেমনি ভিখুর প্রবৃত্তিও ।। কোনও শিক্ষার দ্বারা রুচি , সংস্কার সভ্যতার দ্বারা মার্জিত নয় । সভ্য মানুষের বুদ্ধির বিচার , আইন , নিয়ম , সংস্কার দিয়ে ভিখুর প্রবৃত্তি স্বরূপ বোঝা যায় না । তাই তার  “ প্রাগৈতিহাসিক ”।  সে বাঁচে জৈব তাগিদে , মানুষের মতো নয় ।

[        ] বসন্তপুরে ডাকাতি করতে গিয়ে দলের সবাই ধরা পড়লেও ভিখু বৈকুণ্ঠ সাহার মেজ ভাইকে খুন করে , ডান কাঁধে মারাত্মক ক্ষত নিয়ে রাতারাতি দশ মাইল ছুটে এসে দিনের বেলাটা মাথাভাঙ্গা পুলের নিচে গলা পর্যন্ত কাদায় ডুবিয়ে লুকিয়ে থেকেছে । পরের রাতে আরো নয় ক্রোশ দূরে চিতল পুরে পেহলাদের বাড়িতে পৌঁছে আশ্রয় চেয়েছে । আহত অসুস্থ একটা মানুষ এভাবে এতটা পথ আসতে পারে না জন্তু হলে পারে । ভিখু এখানে জন্তুরই সমান । পুলিশের ভয়ে পেহলাদ ভিখু কে ঘরে জায়গা দিতে সাহস করেনি । পাঁচ মাইল উত্তরের এক বনের মধ্যে বাঁশের মাচা বানিয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছে । প্রতিকূল পরিবেশে , আষাঢ় মাসের বৃষ্টি আর গরমে , মশা , পিঁপড়ে , জোঁকের  আক্রমণ উপেক্ষা করে , বিনা চিকিৎসায় বিনা ওষুধে , বেঁচে উঠতে চায় । “ মরিবে না । সে কিছুতেই মরিবে না । বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সে অবস্থায় , মানুষ সে বাঁচিবেই ।”

[        ] ভিখু বেঁচেছে । পেহলাদ দয়া করে তাকে বাড়িতে এনে মাঁচায় শুইয়ে সেবা করেছে । তাতেই সে সুস্থ হয়ে উঠেছে । শরীরে তাকৎ আসতেই তার নারী সঙ্গের প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে । সে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে ভিখু উপকারী পেহলাদের বউয়েরই হাত ধরে টেনেছে । এই আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে পেহলাদ আর ভরত ভিখু কে মেরে তাড়িয়ে দেয় । মনুষ্যত্বহীন ভিখুর   কোন বিচার নেই  , সমাজ ধর্ম নেই , কৃতজ্ঞতা নেই । তাই , অপকর্ম থেকে নিরস্ত হওয়া দূরে থাক , সে রাতের বেলা পেহলাদের ঘরে আগুন ধরিয়ে , উপকারীর সর্বনাশ সাধন করে জেলে ডিঙি চুরি করে দূরের শহরে যাত্রা করে ।

[        ]  মহকুমা শহরে ভিক্ষা করে বেশ চলছিল ভিখুর ।  কিন্তু এমন চলায় তো তার সুখ নেই । শরীরের সকল চাহিদা যে মেটে না । তাই ভিখারিনী পাঁচীকে  সে রাখনী করতে আগ্রহী হয় । কোন প্রণয় নয় , ভালোবাসা নয় , শুধু পাঁচী র দেহটাকে পাবার জন্য উদ্যোগী হয় । প্রস্তাবও দেয় পাঁচীকে ।  কিন্তু পাঁচী তখন বসির মিঞার রক্ষিতা । বসিরের বাড়ি আছে , জমানো টাকা আছে । তাকে ছেড়ে পাঁচী ভিখুর কাছে আসতে যাবে কেন ? তাই , পাঁচীকে পাবার তাগিদেই ভিখু বসির কে খুন করে ঠান্ডা মাথায় । তারপর বসিরের জমানো টাকা আর পাঁচীকে নিয়ে রাতেই যাত্রা করে আর এক ঠিকানায় সদর শহরের কোথাও ।

[       ] আদিম প্রাগৈতিহাসিক জৈব খিদের  কাছে সম্প্রদায় ভেদ নেই , উঁচু জাত নিচু জাত  নেই , সুন্দর অসুন্দর নেই , তাই , মুসলমান বসিয়ে রক্ষিতা , বিশ্রী ঘাওয়ালী , কদাকার পাঁচী কেও ভিখুর ঘৃনা হয় না । আবার পাঁচী ও চোখের সামনে সঙ্গী কে খুন হতে দেখেও সেই খুনিকেই পরবর্তী সঙ্গী হিসেবে মেনে নেয় । নির্দ্বিধায় ভিখুর পিঠে আশ্রয় নিয়ে ভিন্ন ঠিকানায় যাত্রা করে । এই মন , এই যে প্রবৃত্তি , এই যে জৈব চাহিদা এর উৎপত্তি ও বিকাশের কোনো কার্য কারণ সূত্র নেই । কবে কীভাবে জীবের শরীরে এই প্রবৃত্তির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল , তা কেও জানে না । কেন মানুষ এই বিপজ্জনক প্রবৃত্তি কে ঘোচাতে পারে না , তাও কেউ জানে না । তাই এ প্রবৃত্তি আদিম , প্রাগৈতিহাসিক । লেখক বলেছেন “ পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই , কোনোদিন পাইবেও না ।”

[      ] বোঝা গেল , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিখু আর পাঁচীর  মধ্য দিয়ে সংস্কার মুক্ত কিছু আদিম প্রবৃত্তি স্বরূপ পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন । সেই লক্ষ্য বা অভিপ্রায় সঙ্গে গল্পের বিষয় ও নামকরণ খুবই সঙ্গতিপূর্ণ ও তাৎপর্য পূর্ণ হয়েছে । তাই , নামকরণের সার্থকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না ।





৩টি মন্তব্য: