মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২১

সাঁঝ সকালের মা গল্পের মধ্যে দিয়ে মহাশ্বেতা দেবী কোন সমাজের কোন ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ? তা ছোটগল্পের বিষয় হিসেবে সার্থক কি না বিচার করো প্রশ্নোত্তর

 

বাংলা অনার্স সাম্মানিক bengali honours সাঁঝ সকালের মা গল্পের মধ্যে দিয়ে মহাশ্বেতা দেবী কোন সমাজের কোন ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তা ছোটগল্পের বিষয় হিসেবে সার্থক কি না বিচার করো প্রশ্নোত্তর

উত্তর:- মহাশ্বেতা দেবীর একটি বিখ্যাত ছোটগল্প “ সাঁঝ সকালের মা ” দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে কাজ করবার সুবাদে যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছিলেন , তার উপর ভিত্তি করে মেদিনীপুরে অঞ্চলের পাখমারা  সম্প্রদায়ের চরিত্র অবলম্বনে এই অসাধারণ ও অভিনব গল্পটি রচনা করেছেন । গল্পের প্রধান চরিত্র জটি এবং সাধন কান্দরী । এই দুটি চরিত্র পরিস্ফুটনের প্রয়োজনে আনুষঙ্গিক ভাবে যে সকল চিত্র সমাবিষ্ট হয়েছে , তারই মধ্যে দিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পরিচয় ফুটে ওঠে ।

[      ] গল্পের সূচনায় , অর্থাৎ প্রথম পরিচ্ছেদে সাধনের মা জটির অসুস্থতা , হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া , চিকিৎসা ইত্যাদির বর্ণনা করা হয়েছে । সেখানে সাধনের ও তার মায়ের সংলাপ ডাক্তারের সঙ্গে সাধনের সংলাপ শুনলে আমরা বুঝতে পারি , এরা কোন অনালোকিত আদিবাসি সম্প্রদায়ের স্বরুপ সম্পর্কে আভাস দিচ্ছে । এই পরিচ্ছেদেই আমরা জটি চরিত্রের স্বরূপ কিছুটা আন্দাজ করে নিতে পারি । এই পরিচ্ছেদের শেষে জটি ঠাকুরানীর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।

[        ] দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে লেখিকা ফ্লাশব্যাক করে জটির পূর্ব জীবনের কথা কিছু উল্লেখ করেছেন । যাযাবর শ্রেণীর মানুষ ছিল জটি । তার সঙ্গে প্রণয় হয়েছিল উৎসব কান্দরীর । সে ছিল ভিন্ন সম্প্রদায়ের । সামাজিক নিয়মে তাঁদের মধ্যে বিবাহ হওয়া সম্ভব ছিল না । তাই জটি উৎসবের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে ভিন্ন জায়গায় ঘর বেঁধেছিল । কিন্তু সাধনের জন্মের কিছুকাল পরেই উৎসব মরে যায় । তখন অসহায় জটি শিশু পুত্রকে নিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ে ফিরে আসতে চায় । কিন্তু সেই যাযাবর সম্প্রদায় কে সে আর খুঁজে পায়নি । জটি অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষে হতাশ হয়ে এক সন্ন্যাসীর আশ্রয়ে ওঠে । কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারে না । যুবতী জটির আকর্ষণে দুষ্ট প্রকৃতির , লোকেদের আগমন হয় । সন্যাসী বোঝেন ,  জটিল পক্ষে এখানে থাকা নিরাপদ হবে না । তাই একটা রাঙ্গা চেলি আর শক্তি সাধনার নিদর্শন স্বরূপ একটা ত্রিশূল দিয়ে বলেন “ একদিন তোকে শেয়ালে শকুনে ছিঁড়ে খাবে তা” মনে জানতে পারছি । তবু তুই এই বস্তরে অস্তরে চলে যা মা । এ ঘোর কলিতেও থার কেলাসে সাধু সন্ন্যাসী চলে যেতে পারে , কেউ মাথায় পা দেয় না। ”

[        ]  সেই বস্ত্র আর অস্ত্র ধারণ করেই জটি হয়ে গেল ‘ জটি ঠাকুরানী ’। হাওড়ায় এসে এক ভিখারির বাসায় জটি কিছুদিন থাকে । প্রথম দিকে জটির প্রতি সহানুভূতি থাকলেও পরে তার মনের পাপ ব্যক্ত হয়ে পড়ে । জটি সে আশ্রয়ও ছেড়ে এসে নিজেই একটা আশ্রম তৈরি করে । নিজে ঠাকুরানী সত্তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু ভন্ডামিকে অবলম্বন করে । শিশু পুত্রকেও শিখিয়ে দেয় , সে যেন দিনের বেলায় তাকে আর মা বলে না ডাকে । লোভী মানুষদের হাত থেকে বাঁচতে ,  নিজের ও ছেলের অন্ন জোগাড় করতে এই ভন্ডামিকে আশ্রয় করা ছাড়া জটির আর কোনো উপায় ছিল না । সে যেন ক্ষমতার অধিকারিনী এই ভাবটাও প্রচার করবার ব্যবস্থা করেছিল ।

[       ] জটি একটু আত্মসচেতন হলে অবশ্যই টিকে যেতে পারত । কিন্তু ছেলের জন্য সে যতটা ভাবত , ততটা নিজের জন্য ভাবত না । মানুষকে টোটকা ওষুধ দিয়ে , দান দক্ষিণা , প্রণামী ইত্যাদি নিয়ে যা রোজগার হত, তাতে সাধনকে পেট ভরে খাওয়াত , নিজে থাকত অনাহারে । সারাদিন অনাহারে থাকার ফল স্বরুপ জটি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল । মৃত্যু শিয়রে এসে দাঁড়ানো সত্বেও জটি তার ঠাকুররানী সত্তা ছাড়তে পারেন নি । ছাড়তে পারেনি আদিম  সংস্কার গুলিও । মৃত্যুর পূর্বে সে সাধনকে সাধন কে তাঁর পিতৃ সমপ্রদায়ের পরিচয় জানিয়ে দেয় , বলে “ তোমার বাপ কান্দরী । তোমরা জেতে বেদিয়া । বনে ঘুর , বাদাড়ে ঘুর , আর আশ্চর্যজ্জাচিকন পাটি বুন ।”  এই প্রসঙ্গে জটি নিজের বংশ পরিচয়ও তুলে ধরে । সে ছিল জরা ব্যাধের বংশ ধর , যে জরা ব্যাধ কৃষ্ণকে বানমারা  করেছিল । সেই মহাপাপে সে দেশ ছেড়ে জরার বংশ ধরেরা মেদিনীপুর জেলার কাঁথি , তমলুক , হিজলি অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে । ঐ অঞ্চলে এদের পাখমারা সম্প্রদায় বলে । পাখমারাদের সঙ্গে কান্দরিদের বিবাহ হয় না । তাই , জটি উৎসব কান্দরি কে বিয়ে করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় ।

[      ] লেখিকা জটির এই পরিচয় দানের মধ্যে দিয়ে দুটো আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকখানি পরিচয় তুলে ধরেছেন । এদের সংস্কার গুলিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । শ্রাদ্ধর সময় সোনা , রূপা , অন্ন , বস্ত্র ,  জমি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি দান করলে অনেক পুণ্য হয় । মৃত ব্যক্তির পরকালে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে । সংস্কার বসেই জটি মৃত্যুকালে নিঃস্ব ছেলের কাছে এই সব সম্পদ চায় । গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদে রয়েছে সাধনের মাতৃশ্রাদ্ধর করেছে , সে মাকে হাতি , ঘোড়া , সোনা , রূপা , অন্ন , বস্ত্র দেবার প্রতিশ্রুতি রাখতে চায় । ২১ টি টাকা আর এক পালি চাল ছাড়া সাধন আর কিছু পায়নি । বন্ধু বলরামের চেষ্টায় কালীঘাটের এক পুরোহিত কে বলে মাত্র আঠারো টাকায় সমস্ত দানসহ শ্রাদ্ধ সমাপনের ব্যাবস্থা হয় ।

[       ] গল্পের এই অংশ দরিদ্র মানুষের শ্রাদ্ধর হাস্যকর সংস্কার গুলি সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা হয়েছে । শ্রাদ্ধর দিন যেমন পুরোহিত কে পয়সা ধরে দিয়ে তার মায়ের সকল ইচ্ছা পূরণ করেছে , তেমনটাই এখনো প্রচলিত রয়েছে । পুরোহিত কে পয়সা ধরে দিলেই সব হয় । ক্ষুধার্ত সাধন ভিক্ষে করে পাওয়া টাকাগুলো পুরোহিতকে দিতে পারলেও চাল গুলো দিতে পারেননি । ফেরত নিয়ে রেঁধে খেতে চেয়েছে । বন্ধু বলরাম বারণ করলে সে বলেছে ,  “ চুবো বলরাম !  ঘরে কানাকরি লাই যে ই চাল কিনে আঁধব । চাল আমি হাতছাড়া করি ।” সত্যিই , সাধন চালগুলো নিয়ে , সকলের আপত্তি সত্ত্বেও , বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে ।

[       ] এ গল্পে দুটি অসাধারণ চরিত্র লেখিকা আমাদের উপহার দিয়েছেন । গল্পের কাহিনী ও প্রেক্ষাপট এখানে যথেষ্ট বড়ো , তবে কাহিনী এখানে নয় , চরিত্র দুটিই মুখ্য । সংলাপের ভাষা চরিত্রদুটিকে জীবন্ত করে তুলেছে । চরিত্রদুটির পরিণতি আমাদের ভাবনার তন্ত্রিকে আলোড়ন তুলেছে । সব দিক থেকেই  “ সাঁঝ সকালের মা ” একটি অসাধারণ ছোটগল্প হয়ে উঠেছে ।








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন