ভেবেছিলাম গল্পে গল্প কথকের বাবার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো এবং চরিত্রটি কতটা শিল্প সম্মত হয়েছে আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর
উত্তর:- সন্তোষ কুমার ঘোষের একটা বিখ্যাত ছোটগল্প “ ভেবেছিলাম ” এ গল্পের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি হল গল্প কথকের বাবার চরিত্র । এই বাবা একজন অর্থহীন , কর্মহীন , দিশাহীন অথচ স্ত্রী , পুত্র , কন্যাদের প্রতি দায়িত্বশীল পুরুষ মানুষ । এ রকম একজন ব্যার্থ , হেরে যাওয়া মানুষের যন্ত্রণাই এ গল্পে আভাসিত করে তোলা হয়েছে ।
[ ] মফস্বলের মানুষ বাবা কলকাতার এক ছোট কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন । পরিবার থাকতো গ্রামের বাড়িতে । তাদের জন্য মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠালে তার উপর নির্ভর করে বউ ছেলেমেয়ে খাওয়া পরা চলত । সামান্য টাকায় বৃষ্টি বাদলায় তাদের খুবই কষ্ট হত বলেই কলকাতায় বাসা নিয়ে বউ ছেলে মেয়েকে সেখানে এনে রাখেন । এবার ভালো থাকারই কথা , কিন্তু গরীবের আর ভালো থাকা হয় না । বাবার কারখানার মালিকানা হাতবদল হওয়ায় আপাতত কাজ বন্ধ হল তাই বাবার মতো শ্রমিকের উপার্জনও বন্ধ হল ।
[ ] উপার্জন না থাকায় চারটি মানুষের খোরাক জোগাড় করা খুবই কষ্টকর হয়ে ওঠে বাবার কাছে । স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেন , খুব শীঘ্রই কারখানার কাজ শুরু হবে , সমস্যাও ঘুচে যাবে । কিন্তু ঘোচে না । এক কামরার বাসা , অল্প ভাড়া । তাও বাকি পড়ে যায় । পরিবারকে ভালো রাখার ইচ্ছে থাকলেও অর্থাভাবে পারেন না । মিথ্যা বলতে হয় । স্ত্রীকে থিয়েটারে নিয়ে যাবেন বলেও পারে না । তাই স্ত্রীর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয় । মিথ্যা অজুহাত দিতে হয় ।
[ ] ছেলে মেয়ের আবদার মেটানোর সাধ্যও ছিল না বাবার । দিদির জন্য পামলিভ সাবান মায়ের সুবাসিত তেল এনে দিতে পারেননি । তা ব্যর্থতার যন্ত্রনায় দগ্ধ হতে হতে তাঁর মেজাজটাই খিটে খিটে হয়ে যায় । নিজের ছেলেকে সামান্য দোষে , “ শুয়র কা বাচ্চা ” বলে গালি দেন । মা বাবার দোষ ঢাকতে ভালো ভালো কথা বলেন । যেমন “ প্রাণ দিয়ে লোকের জন্য করত । সমাজসেবা , দেশপ্রেম । তাই তো নিজের কিছু হল না ।” “ এক টাকা পেলে চার টাকা ওড়ায় , একে ওকে দেয় ।”
[ ] বাবার মনের জোর ছিল । ভেঙ্গে পড়তেন না । অন্যদেরও আশান্বিত করার চেষ্টা করতেন । কিন্তু দীর্ঘ দিনের ব্যর্থতা মানুষটাকে একেবারে শেষ করে দেয় । উপার্জনের কত পথই তিনি অবলম্বন করতে চেয়েছেন । ছাপাখানায় কাজ নিতে চেয়েছেন , বাস কন্ডাক্টর হতে চান , বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে চায়ের দোকানও খুলতে চান । এই দোকান খোলার জন্য ঘরের কোণে মাদুর পেতে বসে কত প্ল্যান এস্টিমেট হিসেব নিকেশ করেছেন । পরে জানা গেছে , লোকটা ধান্দাবাজ । বাবা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন । সে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে দিদির হাত ধরেছিল ।
[ ] উপার্জনের ব্যর্থতা বাবাকে একেবারে শেষ করে দেয় । বাড়িতে আত্মীয় কুটুম্ব এলেও তাদের কাছে কিছু পাবার আশায় করতেন । আসা না থাকলে ব্যবহার মন্দ হয়ে যেত । রাঙা জ্যাঠাইমা কলকাতার বাসায় এসে তার সঙ্গে বাবা হাসি ঠাট্টা করলেও মনে ভয় জেগেছে , মানুষটাকে কদিন খেতে দিতে হবে । তাই , বউকে আড়ালে জিজ্ঞাসা করেছেন , “ কতদিন থাকবে বলছে ”
[ ] রাঙা জ্যাঠাইমা থাকতে থাকতেই আসেন বরুণমামা । তাঁর বাড়ি চাটগাঁয়ে কলকাতায় এসেছেন মামলার তদ্বির করতে । থাকবেন মাস খানেক । এই মামা সম্পন্ন মানুষ । গল্প কথক আর তাঁর দিদিকে দুটি রুপোর টাকাও দেন । এই মামা এ বাড়িতে না থেকে দুঃসম্পর্কের বোন বানীর বাসায় থাকতে গেছে জেনে বাবা মায়ের উপর রাগ করেন । জ্যাঠাইমা কদিন থাকলেও একটা টাকা বের করেননি , অথচ বরুণমামা নাকি কটা জিনিস কেনার জন্য বাণী মাসির বরকে একশো টাকার নোট দিয়েছেন । এ বাসায় থাকলে নোটটা নিশ্চয় বাবা পেত , এটা হাত ছাড়া হওয়ায় বাবার রাগ গিয়ে পড়ে রাঙ্গা জ্যাঠাইমার উপরও । তাই গঙ্গা স্নান করে ফেরার সময় দুটো চালতে এনে রাখলে বাবার পদাঘাতে ছিটকে যায় । জ্যাঠাইমা বুঝতে পেরে মনে কষ্ট নিয়ে সেদিনই পরের গাড়িতে চলে যান ।
[ ] দারিদ্র্য যন্ত্রণায় বাবাকে সকলের কাছ থেকে আলাদা করে দিচ্ছিল । তাঁকে ক্রমশ অমানুষ করে তুলছিল । তাই অর্থ লাভের এক হীন উপায় অবলম্বন করতেও ছাড়লেন না । মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে কনে দেখাবার জন্য পাত্রপক্ষ বলে যাদের নিয়ে এলেন , জানা গেল , তারা মেয়েছেলের টাউট । দিদি কে বিক্রি করার চেষ্টা হয়েছে । এতে বাবা মার সম্পর্ক নষ্ট হল । দিদি আত্মহত্যা করতে চাইল । ভালো থাকার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় এসে বাবা মাকে ব্যর্থতা এবং দারিদ্র্য যন্ত্রণায় ধাপে ধাপে নিচে নামতে দেখলেন । বেকারত্ব , ও উপার্জনহীনতা কিভাবে যে মানুষকে নষ্ট করে দেয় , তার আভাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই বাবার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে । লেখক চরিত্রটিকে যথেষ্ট বাস্তব সম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য ও শিল্পসম্মত করেই উপস্থাপিত করতে পেরেছেন ।
কোন মন্তব্য নেই